সবচেয়ে নিঃসঙ্গতায় ভোগে কিশোরীরা, কিন্তু কেন


স্কুল থেকে ফিরে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয় মারিয়া। ১৫ বছর বয়সী কিশোরী সারা দিন বন্ধুদের ইনস্টাগ্রাম স্টোরি দেখে, নিজে কিছু পোস্টও করে। তবে কারও সঙ্গে তেমন কথা হয় না তার। পরিবার-পরিজনের মাঝেও সে একা। তার মতো অসংখ্য কিশোরী এই সময়ে এমন নিঃসঙ্গতায় ভুগছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিশ্বে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ জনগোষ্ঠী হলো কিশোরীরা। বিশ্বব্যাপী প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন কোনো না কোনোভাবে নিঃসঙ্গতা অনুভব করে, আর তাদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ কিশোরী।

গবেষণাটি তৈরি হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন কমিশন অন সোশ্যাল কানেকশন-এর আওতায়। গবেষণার উদ্দেশ্য, কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে, কীভাবে এই নিঃসঙ্গতা তৈরি হচ্ছে এবং তা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে কী প্রভাব ফেলছে, সেগুলো চিহ্নিত করা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তরুণ প্রজন্ম; বিশেষ করে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি নিঃসঙ্গতা অনুভব করছে। বিশ্বজুড়ে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ২০ দশমিক ৯ শতাংশ নিজেদের নিঃসঙ্গ মনে করে। ৩০ বছরের নিচের প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই হার ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের মধ্যে এই সংখ্যা মাত্র ১১ দশমিক ৮ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহসভাপতি ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সার্জন জেনারেল বিবেক মার্থি বলেন, ‘নিঃসঙ্গতা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে ক্ষতিকর। এটা শুধু সামাজিক সংকট নয়, এটি একধরনের মহামারি।’
নিঃসঙ্গতা মানেই একা থাকা নয়, এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কেউ হয়তো জনসমক্ষে থেকেও নিঃসঙ্গতা অনুভব করতে পারেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, নিঃসঙ্গতার অনুভূতি তখন জন্ম নেয়, যখন মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত সামাজিক সম্পর্কগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, নিঃসঙ্গতা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মিলিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৮ লাখ ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্ক। এর ফলে হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, স্মৃতিভ্রম ও বিষণ্নতা পর্যন্ত হতে পারে।
বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই নিঃসঙ্গতার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অতিরিক্ত ও অপরিকল্পিত ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার, বাস্তব জীবনে সামাজিক যোগাযোগ কমে যাওয়া, আত্মমর্যাদার সংকট এবং একাকী বেড়ে ওঠা।

আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই সমস্যা এতটাই বিস্তৃত যে এটিকে ‘অদৃশ্য মহামারি’ বলা হচ্ছে। তবে শুধু সমস্যা তুলে ধরে থেমে থাকেনি এই কমিশন। সুস্থ সামাজিক জীবনের জন্য তারা কিছু কার্যকর পরামর্শও দিয়েছে। যেমন—
- প্রতিটি দেশের সরকার যেন সামাজিক সংযোগ ও নিঃসঙ্গতা নিরসনে বিশেষ নীতি গ্রহণ করে।
- কিশোর–কিশেরীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে স্কুল পর্যায়ে কার্যক্রম চালু করা।
- বয়সভেদে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য ‘কমিউনিটি এনগেজমেন্ট’ প্রোগ্রাম চালু করা।
বিশ্বের কিছু দেশ এরই মধ্যে এসব পদক্ষেপ নিয়েছে। সুইডেন চলতি বছর ৩০ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ করেছে শুধু নিঃসঙ্গতা মোকাবিলায়। তারা বয়স্ক নাগরিকদের জন্য বিশেষ ‘সোশ্যাল রিচিং’ প্রোগ্রাম চালু করছে, পাশাপাশি ১৬–১৮ বছর বয়সী কিশোর–কিশেরীদের দেওয়া হচ্ছে ‘অ্যাকটিভিটি কার্ড’। এই কার্ড দিয়ে তারা খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কিংবা কোনো সামাজিক ইভেন্টে অংশ নিতে পারবে। তবে শর্ত একটাই—এ থেকে যেন অন্যদের সঙ্গে মেশার সুযোগ থাকে।
সুইডেনের জনস্বাস্থ্যমন্ত্রী জ্যাকব ফোরসমিড বলেন, ‘এই সমস্যা শুধু নিঃসঙ্গদের নয়; পুরো সমাজের। সমাজে যদি সম্পর্কের সংযোগ না থাকে, তবে একে একে সবাই একা হয়ে যায়।’
তাই দেরি না করে এখনই সামাজিক সংযোগ বাড়াতে, কিশোর–কিশেরীদের পাশে দাঁড়াতে এবং তাদের মনের কথা শোনার সময় এসেছে। কারণ, নিঃসঙ্গতা নিছক কোনো অনুভব নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থতার প্রশ্ন।
সূত্র: ইউরো নিউজ