খাতুনগঞ্জের ঋণের শতভাগই খেলাপি


চতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক ‘ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি’। ২০১৩ সালে লাইসেন্স পাওয়া এই ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। এই ঋণের প্রায় ৬২ শতাংশ অর্থাৎ ১৭ হাজার ২২৯ কোটি টাকাই নামে-বেনামে হাতিয়ে নিয়েছে বিতর্কিত শিল্পগ্রুপ এস আলম। ঋণের নামে লুট করা এই টাকা সবচেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে ব্যাংকটির চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ইউনিয়ন ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ হয়েছে খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে, যার পরিমাণ ২ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। এই ঋণের ৯৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ (২ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা) এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
ইউনিয়ন ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় ৯৪ শতাংশ অর্থাৎ ২ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা লুট করেছে দেশের বিতর্কিত শিল্পগ্রুপ এস আলম। নামে-বেনামে সংশ্লিষ্ট ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে গ্রুপটি এই ঋণ নেয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে উঠে এসেছে।
ইউনিয়ন ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার কর্মকর্তারা জানান, বিতরণ করা ঋণের বেশির ভাগই দেওয়া হয়েছে প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনায়। তখন পুরো ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল এস আলম গ্রুপের কাছে। গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে এস আলম পরিবারের সদস্যরা দেশে না ফেরায় গ্রুপটির কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে শাখার প্রায় পুরো ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে।
ইউনিয়ন ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক এম রেজাউল করিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনায় খেলাপি গ্রাহকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে এসব গ্রাহকের বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এরপরও ঋণ শোধ না করলে মামলা করা হবে। তবে বেশির ভাগ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে কোনো কোলাটারেল সিকিউরিটি (সহায়ক জামানত) না থাকায় ঋণ আদায় সহজ হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
এস আলম গ্রুপ বিভিন্ন নামে ইউনিয়ন ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নেয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভিক্টোর করপোরেশন ৮৬ কোটি, মুরাদ এন্টারপ্রাইজ ৮০ কোটি, মা-মণি করপোরেশন ১০৯ কোটি, চৌধুরী অ্যান্ড হোসাইন ট্রেড লিংক ৯১ কোটি, সাফরান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ৮৯ কোটি, ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্স ৭৭ কোটি, মুনলাইট ট্রেডিং হাউস ৭৫ কোটি, রিজেনেবল ট্রেডার্স ৮৪ কোটি, ক্রিস্টাল ক্লিয়ার ট্রেড লিংক ৮৬ কোটি, রেইনবো বিজনেস অ্যান্ড ট্রেডিং হাউস ৭৭ কোটি, গ্রিন ক্যাসেল ট্রেডিং হাউস ৭৮ কোটি, ডেলিগেট ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ৬৩ কোটি, গ্রিন এক্সপোজ ট্রেডার্স ৬৬ কোটি, এম আর সি বিজনেস হাউস ৬১ কোটি, গ্লোব ট্রেডার্স ৬৫ কোটি, তৈয়ব অ্যান্ড ট্রেডার্স ৬৪ কোটি টাকা, জাভা রিয়েল স্টেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ১৬ কোটি, শাহ আমানত ট্রেডার্স ৮১ কোটি, একতা এন্টারপ্রাইজ ৬১ কোটি, ইকো ট্রেড কর্নার ১০৪ কোটি, আনসার এন্টারপ্রাইজ ২৩ কোটি, জামশেদ এন্টারপ্রাইজ ৫৭ কোটি, জেএইচ বিজনেস হাউস ৫৭ কোটি, ইউনিক ট্রেড অ্যান্ড বিজনেস হাউস ৮৮ কোটি, এক্সপ্রেস মার্চেন্ট সার্ভিস, ৫৩ কোটি, ইম্পেরিয়াল করপোরেশন ৪২ কোটি, রয়াল এন্টারপ্রাইজ ৭৭ কোটি, লাইনেজ বিজনেস হাউস ৭৬ কোটি, ডিলাক্সিয়াম ট্রেডিং করপোরেশন ৬৩ কোটি, বাণিজ্য বিতান করপোরেশন ৮০ কোটি, জিনিয়াস ট্রেডিং ৫৯ কোটি, মুসা এন্টারপ্রাইজ ৮ কোটি, এস এম ট্রেডিং ৬ কোটি ও ফাতেমা শিপিং লাইনস আড়াই কোটি টাকা ঋণ নেয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ইউনিয়ন ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা ছিল যেন এস আলমের মানিব্যাগ। যখনই কোনো নগদ অর্থের প্রয়োজন হতো তখনই ইউনিয়ন ব্যাংককে বলার সঙ্গে সঙ্গে টাকা পৌঁছে যেত গ্রুপটির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে। কোনো কাগজপত্র ছাড়াই বিভিন্ন মেয়াদে ব্যবসার উন্নয়নের নামে শাখার স্থগিত হিসাব থেকে ৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা নিয়ে গেছে তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউনিয়ন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা উদ্ধারে ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এসব ঋণগ্রহীতার মধ্যে অনেকে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের আত্মীয়, গ্রুপের কর্মকর্তা-কর্মচারী—এমনকি আত্মীয় কিংবা কর্মচারী নন এমন ব্যক্তির নামেও ঋণ নেওয়া হয়েছে। তবে নামে-বেনামে এই ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ।
এস আলম গ্রুপের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, দেশের বিতর্কিত শিল্পগ্রুপ এস আলমের কাছে সরকারি-বেসরকারি কমপক্ষে ২০টি ব্যাংকের ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এস আলম পরিবারের কোনো সদস্য আর দেশে ফেরেননি।
এরপর থেকে গ্রুপটির কর্ণধার, পরিবারের সদস্য ও ঋণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আত্মীয় ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পাওনাদার ব্যাংক ও দুদক। এসব মামলায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন একাধিক আদালত। পাওনা আদায়ে সম্পত্তি নিলামে তুলেছে অনেক ব্যাংক।