নীলফামারীর ডিমলা: খননে আরও ভয়ংকর নাউতারা


ভাঙন রোধে করা হয়েছিল নদী খনন; কিন্তু সেটাই এখন নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার নাউতারা নদীর তীরের মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খননের পর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের মানুষের বসতভিটা, কৃষিজমি, বাঁধ, সড়ক ও সরকারি অবকাঠামো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নদীটি উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, গয়াবাড়ি ও নাউতারা ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ২৫ কিলোমিটার। এটি একসময় কৃষির প্রাণশক্তি ছিল। কৃষকেরা নদীর পানিতে সেচ পেতেন, মাছ চাষ করে জীবনধারণ করতেন; কিন্তু খননের পর নদীর প্রাকৃতিক গতিপথে সৃষ্টি হয়েছে একাধিক চ্যানেল। নদী বিভক্ত হয়ে ভাঙন সৃষ্টি করেছে আরও দ্রুত।
স্থানীয়রা বলছেন, নদী যেন তাদের স্বপ্ন, জীবন ও বাড়ি এক রাতের মধ্যে গ্রাস করে নিয়েছে।
২০০৭ সালে কৃষি সেচ সুবিধার জন্য উপজেলার পূর্ব ছাতনাই এলাকায় এলজিইডি একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে। এর আশপাশে গড়ে উঠেছিল কৃষি ও মাছ চাষনির্ভর জনপদ। কিন্তু ২০২১ সালে নদী খননের পর ধস শুরু হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, অপরিকল্পিত খননে স্লুইসগেট ৬ ফুট নিচে দেবে অকেজো হয়ে যায়, ধসে পড়ে তিনটি সেতু, হেলে পড়ে আরও দুটি। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ছাতনাই, মিয়াপাড়া ও মধ্যপাড়া এলাকার চার কিলোমিটার বাঁধ কাম সড়ক। জমি ও বসতবাড়ি হারিয়েছে নদীর আশপাশের শতাধিক পরিবার।
পাউবো সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নাউতারা নদীর ২৫ কিলোমিটার এলাকা খননের উদ্যোগ নেয়। খনন সম্পন্ন হয় ২০২১ সালে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, স্লুইসগেট ও সেতু ধসে পড়ে রয়েছে নদীতে। ফলে সেচ ও যাতায়াত ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে গেছে।
বাজারে কৃষিপণ্য পৌঁছানো বন্ধ, মাছ চাষও বন্ধ রয়েছে। যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হওয়ায় স্কুল, চিকিৎসা ও হাট-বাজারেও চরম দুর্ভোগ।
স্থানীয়রা জানান, ধস শুরুর পর পাঁচ বছর পার হয়েছে, তবুও ভাঙা স্লুইসগেট, সেতু ও সড়কের ধ্বংসস্তূপ অপসারণ করা হয়নি।
নদীতীরবর্তী পূর্ব ছাতনাই এলাকার বাসিন্দা আলিয়ার রহমান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘চোখের সামনে নদী সব গিলে ফেলল। রান্নাঘর, শোবার ঘর, বাচ্চাদের বই-খাতা—এক রাতেই শেষ। প্রাণ নিয়ে বাঁচলাম, কিন্তু ভিটে তো আর ফেরত পাওয়া যাবে না। এখন শেষসম্বল আবাদি ২ বিঘা জমিও নদী গিলছে।’
মিয়াপাড়ার কৃষক লাল মিয়া বলেন, ‘৩ বিঘা জমি ছিল। ধান-ভুট্টা চাষ করতাম। নদী সব নিয়ে গেছে। এখন মজুরি খেটে বাঁচি।’
শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে রহিমা বেগম নামের এক গৃহবধূ বলেন, ‘রাস্তা নাই, সেতু নাই বাজারে যাইতে পারি না, ডাক্তার দেখাইতে পারি না। সন্তান অসুস্থ হলে বুক ফেটে যায়, কিন্তু কিছু করার উপায় নাই।’
রাস্তা ভেঙে পড়ায় স্কুলগামী শিশুদের প্রতিদিন কাদা-পানি মাড়িয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। শিক্ষার্থী খাদিজা আক্তার বলে, ‘স্কুলে কাদা মাড়িয়ে যেতে যেতে প্রায়ই দেরি হয়ে যায়। পড়াশোনায় মনও বসে না। অনেক সময় মনে হয়, আমাদের স্বপ্নও নদীর জলে তলিয়ে যাচ্ছে।’
জানা যায়, নদীভিত্তিক কৃষির সুবিধা কাজে লাগাতে এলজিইডি গড়ে তুলেছিল ‘ক্ষুদ্র পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি’। পাঁচ শতাধিক সদস্যের সমিতি চাঁদা দিয়ে সেচব্যবস্থা চালাত, নদীতে মাছ চাষ করত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমিতির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘খননের পর সবকিছু ভেঙে গেছে। আমাদের স্বপ্নই নদীর গর্ভে হারিয়ে গেছে। পাঁচ বছর পার হয়েছে, তবুও নদীতে ভেঙে পড়া ধ্বংসস্তূপ অপসারণ করা হয়নি। এভাবে নদীর ভাঙন আরও ভয়াবহ হয়ে গেছে। আমাদের জীবন এখন অনিশ্চয়তার খাঁচায় বন্দী। সরকার যদি পাশে না দাঁড়ায়, এলাকা জনশূন্য হয়ে যাবে।’
সমিতির সদস্য মোক্তার আলী বলেন, ‘উন্নয়নের নামে নেওয়া উদ্যোগ যদি মানুষের জীবন, জীবিকা ও স্বপ্নকে নষ্ট করে, তবে সেটি কী সত্যিই উন্নয়ন? নাউতারা নদীর ভাঙনের গল্প যেন সে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।’
নদী নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও’ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সদস্য সোহেল হাসান বলেন, ‘নদী খননের আগে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন অত্যন্ত জরুরি। নাউতারায় সে নিয়ম মানা হয়নি। ফলে ভাঙন ঠেকাতে খনন প্রকল্পটি এখন পরিণত হয়েছে সর্বনাশের কারণ।’
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, খননের পর নদীতে ভেঙে পড়া অবকাঠামোর কারণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ভাঙন বাড়ছে। অবকাঠামোগুলো এলজিইডির আওতায়। তাই অপসারণ করা হয়নি। দ্রুত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পরিবেশগত মূল্যায়ন ও টেকসই প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি পরে যোগদান করেছি।’
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ডিমলা উপজেলা প্রকৌশলী শফিউল ইসলাম ও জেলা প্রকৌশলী ফিরোজ হাসান কথা বলতে রাজি হননি।
ক্রাইম জোন ২৪