বরাদ্দের পরও গতি নেই কাজে


নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে নতুন শিক্ষাক্রম বিস্তরণ (ডেসিমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম) স্কিম নিয়েছিল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন স্থগিত করে অন্তর্বর্তী সরকার। পরে এই স্কিম সংশোধন করে মাউশি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে গত ১০ মাসে কাজের অগ্রগতি নেই। বিগত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই স্কিমে আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
একই অবস্থা মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠ্যাভ্যাস ও পঠন দক্ষতা শক্তিশালীকরণ (স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস) স্কিমের। গত অর্থবছরে এই স্কিমে ২৭৭ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও খরচ হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
শুধু এ দুটি স্কিম নয়, মাউশি অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ৯টি প্রকল্প ও ৩ স্কিমের বেশির ভাগই এখন বেহাল। টাকা বরাদ্দ থাকলেও কাজ না হওয়ায় খরচও হচ্ছে না। কাজে অগ্রগতি না থাকায় এসব প্রকল্প ও স্কিম কবে নাগাদ বাস্তবায়ন হবে, তা-ও অনিশ্চিত।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর মাউশির বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প ও স্কিমের এই চিত্র উঠে এসেছে (জুলাই ২০২৪-জুন ২০২৫ পর্যন্ত) উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায়। গত ২৬ জুলাই মাউশিতে অনুষ্ঠিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন মাউশির মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খান। ৩০ জুলাই সভার কার্যবিবরণী স্বাক্ষরিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়িত না হলে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকেরা দায়ী থাকবেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল (সি আর) আবরার ১০ আগস্ট আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে জেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে (২০২৪-২০২৫) মাউশির বাস্তবায়নাধীন ৯ প্রকল্প ও ৩ স্কিমের মধ্যে শুধু সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন প্রকল্পের আর্থিক ও ভৌত অগ্রগতি সন্তোষজনক। বাস্তবায়নাধীন অন্য আট প্রকল্প হলো—তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজসমূহের উন্নয়ন, সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম, ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম ও নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটিজ, আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (পর্যায়-২, প্রথম সংশোধিত), ঢাকা শহরের সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন (প্রথম সংশোধিত), সরকারি কলেজসমূহের বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ, ৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন, লার্নিং এক্সিলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন প্রজেক্ট।
মাউশির বাস্তবায়নাধীন তিনটি স্কিম হলো—স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস, পারফরম্যান্স বেজড গ্র্যান্টস ফর সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউশন এবং ডেসিমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কিম।
এসব প্রকল্প ও স্কিম বাস্তবায়নে অগ্রগতি না থাকার বিষয়ে জানতে মাউশির ডিজিকে একাধিকবার মোবাইলে ফোন ও এসএমএস করা হলেও সাড়া দেননি। একাধিকবার তাঁর কার্যালয়ে গিয়েও সাক্ষাৎ মেলেনি।
২৬ জুলাইয়ের সভার কার্যবিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, টাকা খরচের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে না পারা, ব্যয়ের সক্ষমতা বিবেচনা না করে এডিপি-আরএডিপি প্রণয়ন, মাঠপর্যায়ের প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা না করে প্রকল্প প্রণয়ন করাসহ নানা কারণে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই। এর কোনো কোনোটির মেয়াদও শেষের পথে।
মাউশির সূত্র বলছে, তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত প্রকল্পের মেয়াদ গত ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়ায় এত দিন সব কার্যক্রম বন্ধ ছিল। সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম প্রকল্পের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়িয়েও প্রকল্পে নিয়োগ করা জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা যায়নি। এই জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের কাজ চলছে। ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম ও নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটিজ প্রকল্পটি অসমাপ্ত রেখেই সমাপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মেয়াদ শেষ হওয়ায় আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (পর্যায়-২, প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
সূত্র বলছে, সরকারি কলেজসমূহের বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ এবং ৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের মেয়াদ শেষের পথে। লার্নিং এক্সিলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন প্রকল্পের প্রশিক্ষণ ও কেনাকাটা মাত্র শুরু হয়েছে। ঢাকা শহরের সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পে অধিকাংশ ভবনের নির্মাণকাজ পুরোদমে চলছে। তবে পারফরম্যান্স বেজড গ্রান্টস ফর সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউশন স্কিম বাস্তবায়নের অগ্রগতি তুলনামূলক সন্তোষজনক। অবশ্য সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের উন্নয়ন প্রকল্পের। গত অর্থবছরে এই প্রকল্পের এডিপি/আরএডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতি ৯৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ। গত দেড় বছরে সার্বিক অগ্রগতি ১৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩১ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাউশির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, মাউশির বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর মধ্যে গত এক বছরে শুধু সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের উন্নয়ন প্রকল্পই সফলভাবে এগিয়েছে। প্রকল্পের ৩২০টি একাডেমিক ভবনের মধ্যে ৯৪টির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে, ১৮২টির নির্মাণকাজ চলছে। বাকি ভবনগুলো নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের অন্যান্য অনুষঙ্গ বাস্তবায়নের হারও সন্তোষজনক।
সূত্র আরও বলছে, মাউশির বাস্তবায়নাধীন তিনটি স্কিমেরই মেয়াদ প্রায় শেষ। এ তিন স্কিমের মেয়াদ বাড়াতে হলে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের মেয়াদ বাড়াতে হবে।
প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিটি প্রকল্পের নির্মাণ, কেনাকাটা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে হবে। না হলে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক দায়ী থাকবেন।
ক্রাইম জোন ২৪