জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে সব কর অঞ্চল, কাস্টম হাউস ও ভ্যাট কমিশনারেটে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। বন্দরে কোনো রকম আমদানি-রপ্তানি না হওয়ায় হাজার হাজার কনটেইনার ও ট্রাকের জট তৈরি হয়েছে। পণ্যের শুল্কায়ন ও রাজস্ব না হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছে অর্থনীতি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল রোববার বলেন, ‘এটা রপ্তানি-আমদানি, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিষয়টা সার্বিকভাবে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। সরকার এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানো জরুরি হয়ে পড়েছে।’

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, সরকারের এনবিআর পৃথক্‌করণের সিদ্ধান্তটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী হয়নি। সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে হয়তো এর সমাধান পাওয়া যাবে।

কমপ্লিট শাটডাউনের কারণে প্রতিদিন আড়াই হাজার কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু এ অঙ্কটির কথা উল্লেখ করেন।

তথ্য বলছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর, শুল্ক ও মূসক—এই তিন খাত থেকে প্রতিদিন গড়ে ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আদায় করা হয়। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৯৭৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। বছরের শেষ দিকে রাজস্ব আদায়ের হার বেশি থাকে। ফলে এনবিআরের কার্যক্রম বন্ধ থাকলে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ক্ষতি হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

চলতি অর্থবছরে এমনিতেই বড় রাজস্ব ঘাটতির মুখে পড়েছে এনবিআর। বছরটিতে রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে জুন মাসেই সব মিলিয়ে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা বা প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি শুল্ক-কর আদায় করতে হবে, যা রীতিমতো অসম্ভব বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আদায় বন্ধ রয়েছে।

বন্দরগুলোর অবস্থা

দিনে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার পণ্যবাহী কনটেইনার খালাস হয়ে থাকে। রপ্তানিমুখী কনটেইনারের সিংহভাগই পোশাকশিল্পের। কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের কাছে এসব পণ্য সময়মতো পৌঁছাতে সমস্যা হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আখাউড়া, ভোমরা, বুড়িমারী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ স্থলবন্দরগুলোতেও শত শত পণ্যবাহী ট্রাক আটকা পড়ে ছিল।

চট্টগ্রাম কাস্টমস: চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয় ৬৮ হাজার ৫৬২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৮৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। কিন্তু অর্থবছরের শেষ সময়ে জুন মাসে প্রায় প্রতিদিন ২০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় হয়। সেই হিসাবে গত দুই দিনে ৪০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া প্রতিদিন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ২ হাজার আমদানি পণ্যের চালান ও ৫ হাজার রপ্তানি পণ্যের চালান শুল্কায়ন হয়ে থাকে।

চট্টগ্রাম কাস্টম এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদি ইমাম বিলু জানান, আন্দোলনের কারণে গত দুই দিনে অন্তত ৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়নি।

বেনাপোল: যশোরের বেনাপোল কাস্টম হাউসের রাজস্ব আহরণকারী বেনাপোল সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার জহির রায়হান জানান, প্রতিদিন গড়ে তাঁদের ব্যাংকে ৫০ কোটি টাকা রাজস্ব জমা হয়। তবে কমপ্লিট শাটডাউনে পুরোটাই বন্ধ রয়েছে।

আখাউড়া: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরেও কোনো ব্যবসায়িক কাগজপত্রে স্বাক্ষর দেওয়া হয়নি। বন্দরের ব্যবসায়ী নেসার আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘শাটডাউনের কারণে বন্দরে কোনো মালামাল আসেনি।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা নুরুল হাসান জানান, বন্দরে রপ্তানি পণ্যবোঝাই অন্তত ১৬টি ট্রাক আটকা পড়েছে। অন্যদিকে ভারতের মহদিপুর স্থলবন্দরে কয়েক শ আমদানি পণ্যবাহী ট্রাক আটকা পড়েছে।।

বুড়িমারী: লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারী স্থল শুল্ক স্টেশনে শাটডাউনের কারণে প্রতিদিন সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে প্রায় অর্ধকোটি টাকা। স্থলবন্দরে ইয়ার্ডে (মাঠে) ভারত থেকে আসা ১৪টি পণ্যবাহী গাড়ির শুল্কায়ন হয়নি। স্থলবন্দরের সড়কে রপ্তানি পণ্য নিয়ে দুটি ট্রাক তিন দিন ধরে পড়ে রয়েছে।

ভোমরা স্থলবন্দর: সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশানের সাধারণ সম্পাদক আবু মুসা জানান, গত দুই দিনে ভোমরা ও ভারতের ঘোজাডাঙ্গা স্থলবন্দরে আমদানি রপ্তানির অপেক্ষায় থাকা অন্তত ৫০০ ট্রাক আটকা পড়েছে।