[ad_1]
চলতি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বছরের মধ্যে শীর্ষে উঠেছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত যত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তার ৫৬ শতাংশই এসেছে জুনে। জুনে রোগী বৃদ্ধির এই ধারা এ পর্যন্ত রেকর্ড। রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন, আগামী তিন থেকে চার মাস রোগীর সংখ্যা বাড়া চলতে পারে। তাঁদের আশঙ্কা, রোগী বৃদ্ধির গতি এবং মৃত্যুও বাড়তে পারে কয়েক গুণ।
বছরের শুরু থেকে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির সংখ্যা ছিল এক শর কম। জুনে এসে ভর্তির সংখ্যা বাড়ে কয়েক গুণ। আর মোট আক্রান্তের ৩৯ শতাংশই ডেঙ্গুর কবলে পড়েছে গত দুই সপ্তাহে। একই সঙ্গে বেড়েছে চিকিৎসাধীন রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা। বর্তমানে দৈনিক কয়েক শ মানুষ এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত মোট যে ৪২ জন চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে, তার ১৯ জনই মারা গেছে জুনে।
দিনপঞ্জির হিসাবে জুনের মাঝামাঝিই শুরু হয়েছে বর্ষাকাল। আগে এ সময়ে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার প্রজনন বেড়ে যেত। সাধারণত মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি থাকত। তবে গত কয়েক বছরে প্রবণতা বদলে গেছে। এখন ডেঙ্গু কমবেশি সারা বছরই থাকছে। তাই রোগতত্ত্ববিদেরা বলেছেন, ডেঙ্গু রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সারা বছরই চালু থাকা উচিত।
পরিসংখ্যান বলছে, আগের বছরগুলোতে জুন মাসে এত বেশি রোগী দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টির মৌসুম শুরু হয়ে যাওয়ায় দৈনিক রোগী বৃদ্ধির সংখ্যা হাজারের ওপরে উঠতে পারে। এভাবে রোগী বাড়তে থাকলে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুও কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
সরকারের ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বছরের শুরু থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে ৯ হাজার ৮৬৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। মাসভিত্তিক হিসাবে জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১ এবং মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ জন। আর শুধু জুন মাসে ৫ হাজার ৫২২ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। সে হিসাবে মোট রোগীর ৫৬ শতাংশই আক্রান্ত হয়েছে জুনে। এ মাসের শেষ দুই সপ্তাহে হাসপাতালে রোগী এসেছে পৌনে ৪ হাজার, যা মোট রোগীর ৩৯ শতাংশ।
রোগ বৃদ্ধির এ ধারা সামনের মাসগুলোতে আরও বেশি দেখা যেতে পারে বলে সতর্ক করেছেন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ডেঙ্গুর যে চারটি ধরন রয়েছে, তার মধ্যে বর্তমানে ডেন-২ ও ডেন-৩-এর সংক্রমণ বেশি। তবে দেশে ডেঙ্গুর ধরনগুলো নিয়ে কোনো জিনগত গবেষণা নেই, ফলে এর মিউটেশন (রূপান্তর) হচ্ছে কি না, তা জানা যাচ্ছে না।
রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু বৃদ্ধির জন্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশদূষণ এবং ব্যবস্থাপনা দায়ী বলে মন্তব্য করেন এই বিশেষজ্ঞ। তাঁর মতে, জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এডিস মশা বৃদ্ধির ফলে ডেঙ্গুও বৃদ্ধি পেতে পারে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুর একসময়ের একক কেন্দ্র রাজধানীতে চলতি বছর তুলনামূলকভাবে কম রোগী দেখা যাচ্ছে। মোট রোগীর ২২ শতাংশ চিকিৎসা নিয়েছে রাজধানীর হাসপাতালে। এখন সবচেয়ে বেশি রোগী বরিশাল বিভাগে। মোট ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে বিভাগটিতে।
ডেঙ্গুর এ পরিস্থিতিতে রোগ ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, চিকিৎসার বিকেন্দ্রীকরণ করা প্রয়োজন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে রোগ পরীক্ষা, ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে মাধ্যমিক হাসপাতালে (জেলা ও জেনারেল হাসপাতাল) পর্যবেক্ষণে রাখা এবং সংকটাপন্ন রোগীকে টারশিয়ারি (মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতাল) স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে চিকিৎসা দিতে হবে। এতে রোগী শনাক্ত বাড়লেও মৃত্যু কমবে। একই সঙ্গে সব রোগীর সঠিক তথ্য সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা করা যাবে। যথাযথ রোগ ব্যবস্থাপনা করতে হলে প্রায় শতভাগ রোগীকে শনাক্ত করতে হবে।
ডেঙ্গু ঠেকাতে মশা নিধনেও নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন রোগতত্ত্ববিদ মুশতাক হোসেন। তাঁর ভাষ্য, শুরু থেকেই এডিস মশা নির্মূলে সরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম যথাযথ হচ্ছে না। ডেঙ্গুর বাহক মশা পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজন করে নিচ্ছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। রোগপ্রতিরোধ এবং রোগী ব্যবস্থাপনায় সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। রোগটি সারা দেশে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, প্রতিবছরই স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় একটি বিপর্যয়মূলক অবস্থার সৃষ্টি করে।
রোগীর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর জন্য সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্বে থাকা সরকারি এই কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক মো. হালিমুর রশিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘একটি অভিন্ন গাইডলাইনের আলোকে চিকিৎসকেরা সারা দেশে চিকিৎসা দিচ্ছেন। রোগী বৃদ্ধির বিষয়টি আমরা পর্যালোচনা করছি।’
সরকারের ডেঙ্গুবিষয়ক পরিসংখ্যান মূলত নির্ধারিত কিছু সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি। এর বাইরে সারা দেশে বহু হাসপাতালে রোগী থাকলেও তাদের তথ্য নেওয়া হয় না। অনেকে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতেই থাকছে, কেউ কেউ মারাও যাচ্ছে। এসব বিষয় দাপ্তরিক পর্যবেক্ষণের বাইরে থেকে যায়।
শুধু হাসপাতালভিত্তিক তথ্যের আলোকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোগের ব্যবস্থাপনা করা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীর তথ্য শুধু কয়েকটি হাসপাতালভিত্তিক। ডেঙ্গুর জন্য যে পর্যায়ে রোগীর সার্ভিলেন্স প্রয়োজন, তা নেই। সব রোগীকেই পর্যবেক্ষণ করতে হবে। রোগ শনাক্ত হয়েছে, কিন্তু হাসপাতালে যারা আসেনি তাদের কী অবস্থা তা-ও জানতে হবে। এ ছাড়া ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে জনসম্পৃক্ততা ও সচেতনতা বাড়াতেই হবে।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় মৃত ১
শনিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৩৮৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া একজনের মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, নতুন ভর্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী বরিশাল বিভাগের, ১৩৬ জন। এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ, যেখানে ভর্তি হয়েছে ৫৫ জন। ঢাকায় সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকায় ভর্তি হয়েছে ৪৮ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩২ জন এবং দক্ষিণ সিটিতে করপোরেশনে ২৮ জন। খুলনা বিভাগে নতুন ভর্তি হয়েছে ৪১ জন, রাজশাহীতে ৩৩ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ জন।
[ad_2]
ঠিকানা: ১১৮ হাবিব ভবন ৪র্থ তলা, বিবিরপুকুর পশ্চিম পাড়, বরিশাল-৮২০০
মোবাইল: 01713956574, 01712445776 ইমেইল: [email protected]