শিরোনাম

নৌকার গায়ে হাতুড়ির শব্দে জেগে ওঠে পাটকেলঘাটা

নৌকার গায়ে হাতুড়ির শব্দে জেগে ওঠে পাটকেলঘাটা

সাতক্ষীরার তালার পাটকেলঘাটায় সকাল শুরু হয় কাঠের গায়ে করাতের ঘর্ষণ, হাতুড়ির টুংটাং শব্দে, আর আলকাতরার কড়া গন্ধে। যেন একটা গ্রাম নয়, কারখানা—যেখানে কাঠের গায়ে গায়ে গড়ে ওঠে নৌকা। সেই নৌকা বয়ে চলে নদীর স্রোত, পাড়ি দেয় মাছের ঘের, কিংবা মানুষের জীবনযাত্রার প্রয়োজন মেটায় বছরের পর বছর।

একসময় নদী ছিল এই দেশের মেরুদণ্ড। নৌকাই ছিল চলাচলের প্রধান মাধ্যম। সময় বদলেছে, নদী সরে গেছে পেছনে, তবে নৌকার চাহিদা হারিয়ে যায়নি। বরং প্রকৃতির আচমকা রূপে যখন আগাম বৃষ্টি নামে, তখন আবার ফিরেও আসে নৌকার প্রয়োজন। ঠিক যেমনটা ঘটেছে এ বছর।

পাটকেলঘাটায় এমনই ছয়টি নৌকা কারখানা আছে, যেখানকার কারিগরেরা প্রতিদিন নিপুণ হাতে কাঠের শরীরে প্রাণ বসান। কেউ হাতুড়ি চালান, কেউ দড়ি টানেন, কেউ কাঠ ঘষে করেন পালিশ। কাঁধে জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করেন ৬৫ বছরের মারজান গাজী, যিনি বলেন, “৫০ বছর ধরে নৌকা বানাচ্ছি। নদী কমলেও চাহিদা এখনও আছে। এই তো, এ বছর জলাবদ্ধতায় আগের চেয়ে বেশি নৌকা বানাতে হচ্ছে। ”

এখানে ট্রলার, পালতোলা, কোশা কিংবা ডিঙ্গি—সব ধরনের নৌকা তৈরি হয়। মেহগনি, খৈ, চম্বল কাঠ দিয়ে তৈরি এই নৌকাগুলো কিনে নেন সাতক্ষীরা, খুলনা, এমনকি দেশের দূর-দূরান্তের ব্যবসায়ীরা। একেকটি মাঝারি নৌকা বানাতে লাগে দুজন কারিগরের দুদিনের শ্রম। দাম পড়ে ১৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।

নৌকা কিনতে আসা কলারোয়ার মাছচাষি মহিব বিল্লাহ বলেন, “আগাম বৃষ্টিতে আমাদের এলাকা জলে ভাসছে। মাছ ঘেরে কাজ করতে হলে নৌকা ছাড়া উপায় নেই। অনেক দরকষাকষি করে একটা কিনেছি। ”

এই শিল্পে কিন্তু মুনাফা বেশি নয়। ‘মেসার্স ঐশী’ নৌকা কারখানার মালিক শেখ আনোয়ার হোসেন বলেন, “এই কাজ লাভের চেয়ে ভালোবাসার। কাঠ, পেরেক, পিচ—সবকিছুর দাম বেড়েছে। শ্রমিকদের বেতন, জায়গার ভাড়া, সব খরচ মিটিয়ে হাতে যা থাকে, তাও কম। কিন্তু নৌকা না বানিয়ে থাকতেও পারি না। ”

একই সুরে কথা বলেন ‘সুমি ফার্নিচার অ্যান্ড নৌকা কারখানা’র মালিক জাকির হোসেন ও ‘তৈয়েবা নৌকা কারখানা’র মালিক আক্তারুজ্জামান বিশ্বাস। তাঁদের ভাষায়, “নৌকা আমাদের পেশা না, পরিচয়। ”

পাটকেলঘাটা বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ সরদার বলেন, “এই শিল্পকে কেন্দ্র করেই স্থানীয় বহু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। সরকার একটু নজর দিলে নতুন উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসতো। ”

তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মো. রাসেল আশ্বাস দেন, “সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্রঋণ বা অনুদানের সুযোগ থাকলে আমরা তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করব। এমন শিল্প যেন টিকে থাকে, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। ”



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button