গণশৌচাগারে নিত্য বিড়ম্বনায় নারী


পড়াশোনা, পেশাগত দায়িত্ব পালনসহ নানা কাজে প্রতিদিনই ঘরের বাইরে যেতে হয় নারীদের। বাইরে থাকাকালে নারীদের সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় পড়তে হয় শৌচাগার ব্যবহার নিয়ে। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে দুই সিটি করপোরেশনের তৈরি করা অনেক গণশৌচাগার রয়েছে; কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই নারীবান্ধব নয়। নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন না হওয়ায় শৌচাগার ব্যবহারে প্রতিদিনই সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হয় নারীদের।
সরেজমিন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণের সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) একাধিক গণশৌচাগারে গিয়ে দেখা যায়, নারীদের জন্য নির্ধারিত অনেক শৌচাগারের কোনোটিতে ছিটকিনি নেই, কোনোটির বদনা নোংরা, আবার কোনোটিতে নেই ময়লার ঝুড়ি বা হাত ধোয়ার স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা। বেশির ভাগ গণশৌচাগারে নেই স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভেন্ডিং মেশিন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন-সংলগ্ন ডিএসসিসির গণশৌচাগার গিয়ে দেখা যায়, কোনো নারী শৌচাগার ব্যবহার করতে চাইলেই তাদের পুরুষদের জন্য নির্ধারিত শৌচাগারে যেতে বলেন ইজারাদারের নিয়োজিত কর্মী দিল ইসলাম। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, নারীদের শৌচাগারে ছিটকিনি নেই।
পান্থকুঞ্জে অবস্থিত ডিএসসিসির গণশৌচাগারে গিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভেন্ডিং মেশিন, জুতা ও মালপত্র রাখার জায়গা দেখা গেলেও নারীদের শৌচাগারগুলোর ভেতরটা বেশ নোংরা। এ নিয়ে দায়িত্বরত নারী কর্মীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘গণশৌচাগারে একটু ময়লা তো থাকবেই।’
গণশৌচাগারের এমন বেহাল দশা কেন জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) হাসিবা খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইজারা দেওয়ার পর গণশৌচাগারের বিষয়গুলো ইজারাদারেরা দেখেন। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে এমন কোনো অভিযোগ আসেনি। কেউ অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’ তিনি আরও বলেন, সিটি করপোরেশন গণশৌচাগারে নারীদের মাসিক ব্যবস্থাপানার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে তা পুরোপুরি বাস্তবায়নে কিছুটা সময় লাগবে।
শুধু সিটি করপোরেশনের গণশৌচাগার নয়, রাজধানীর হাসপাতাল, মেট্রোরেল স্টেশন ও অনেক নামীদামি শপিং মলেও শৌচাগার পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টি উপেক্ষিত। আবার নারীদের পিরিয়ড ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণও থাকে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেবা নিতে আসা নারীদের শৌচাগার ব্যবহার নিয়ে বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয়। হাসপাতালটিতে মাতুয়াইল থেকে আসা রোকেয়া বেগম নামের এক নারী জানান, অর্থোপেডিক বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা নিতে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর প্রস্রাবের চাপ অনুভব করলে হাসপাতালে হন্তদন্ত হয়ে শৌচাগার খুঁজছিলেন তিনি। ইমার্জেন্সি ওপারেশন থিয়েটার কমপ্লেক্সের পাশে একটি শৌচাগারের সন্ধান পেলেও তা এত নোংরা ছিল যে, তিনি সেখানে একদণ্ড না দাঁড়িয়ে দ্রুত অন্যদিকে শৌচাগার খুঁজতে থাকেন। পরে হাসপাতাল অঙ্গনে টাকা দিয়ে ব্যবহার করতে হয় এমন একটি নারী শৌচাগারে গিয়ে দেখতে পান, ভেতর থেকে একজন পুরুষ বের হচ্ছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে কথা হলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, হাসপাতালের জায়গার ঘাটতি রয়েছে, ফলে প্রয়োজনের তুলনায় শৌচাগারের সংখ্যা কম। ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি হওয়ার পাশাপাশি সঠিক উপায়ে ব্যবহার না করার কারণে শৌচাগারগুলো দ্রুত নোংরা হয়। এ ছাড়া পরিচ্ছন্নতার জন্য আমাদের কর্মী ও বাজেটের অভাব রয়েছে।
শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরই নয়, ঢাকার সরকারি অন্যান্য হাসপাতালের শৌচাগারগুলোর অবস্থাও একই রকম। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে ৭৯ শতাংশ শৌচাগার যৌথভাবে ব্যবহৃত হয়, আর মাত্র ১০ শতাংশ টয়লেট নারীদের জন্য নির্ধারিত। আর মোট শৌচাগারের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পরিচ্ছন্ন থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অনেক শৌচাগারও নারীবান্ধব নয় এখন। ঢাবির লেকচার থিয়েটারের শৌচাগারগুলো বেশ অপরিচ্ছন্ন। শিক্ষক-ছাত্রকেন্দ্রে (টিএসসি) থাকা তিনটি নারী শৌচাগারের মধ্যে দুটি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারের অনুপযোগী। বাকি একটি টয়লেটও নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না।
সায়েমা সুলতানা নামের এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীদের শৌচাগারের সংকট সঙ্গে এমন অব্যবস্থা স্বাস্থ্যঝুঁকি তো বাড়াচ্ছেই, পাশাপাশি দৈনন্দিন চলাফেরা সৃষ্টি করছে দুঃসহ পরিস্থিতি। আমরা চাই এই অবস্থার দ্রুত সমাধান হোক।’
ঢাকার একটি সংবাদপত্রে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন নাইমা হক। অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ভালো শৌচাগারের অভাবে প্রায়ই প্রস্রাবের চাপ অনুভব করলেও চেপে রাখি। এই অস্বস্তি এড়াতে বাসা থেকে বের হলে পানি কম পান করতে হয়।
প্রয়োজনের তুলনায় পানি কম পান ও দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব চেপে রাখা সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, পানি কম পান করলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা যায়। আর দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব চেপে রাখলে নারীদের মূত্র সংবহনতন্ত্রে সংক্রমণ হতে পারে। দীর্ঘদিন এই অবস্থা থাকলে কিডনি সংক্রমণ হয়।