রাজধানীর রামপুরা ব্রিজের দুই রেলিং ঢুকে আছে একটি বাসের মাঝ বরাবর। যাত্রী নিতে আরেক বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে ‘রইছ’ নামের বাসটির এই দশা হয়। ৪ জুন সকালের এই দুর্ঘটনায় বাসটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। যাত্রী বেশি নিতে বাসচালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, লক্কড়ঝক্কড় ও ফিটনেসবিহীন বাস দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে নগরের সড়কে। ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে মানুষের চলাচল।

মাঝে মাঝে অভিযান চললেও থেমে নেই প্রতিযোগিতা, ফিটনেসবিহীন বাসের চলাচল। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, ট্রাফিক পুলিশ জরিমানা করলেও লক্কড়ঝক্কড় বাস চলছেই।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নগরের বিভিন্ন রুটে চলাচল করা বেশির ভাগ বাসের জীর্ণ দশা। বাসের সঙ্গে ঘষায় বাইরের রং চটে গেছে। আসন ও জানালা ভাঙা। কোনো কোনো বাসের বাইরের কিছু অংশ ভাঙা। কোনোটির ভেতরের ফ্যানগুলোর কিছু নেই। কিছু থাকলেও অকেজো। কোনোটির বাম্পার ভাঙা। ব্রেক, হেডলাইট, সিগন্যাল লাইট ও স্টিয়ারিংয়েও ত্রুটি রয়েছে। কালো ধোঁয়া বের হয়। এ ছাড়া ইঞ্জিনে সমস্যার কারণে মাঝপথে হঠাৎ বাস বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন ত্রুটি থাকে।

একটি তথ্য বলছে, ঢাকার বিভিন্ন রুটে চলা মোট বাসের ৮৫ শতাংশই ফিটনেসবিহীন। এগুলোর ২২ শতাংশের ফিটনেস সনদও নেই।

সেবা অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের ইঞ্জিনমিস্ত্রি মো. জসীম জানান, কেবল কাগজপত্র আপডেট করলেই ফিটনেসবিহীন গাড়ি ফিট হয় না। গাড়ির ইঞ্জিন, চেসিস, সিট, বাম্পার, ব্রেক, লাইট, বডিসহ সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হয়।

১৬ জুন ভিক্টর পরিবহনের একটি বাসকে ফিটনেস সনদ না থাকায় একটি মামলায় ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তবে বাসটির কন্ডাক্টরের দাবি, নতুন বাস দেখে বিনা কারণে মামলা দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বলছে, বেপরোয়া গতি ও ফিটনেসবিহীন বাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। চালক ও মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ২ জুন এক দিনে ১ হাজার ৮৫০টি মামলা করেছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। এ ছাড়া চলতি মাসের শুরুর কয়েক দিনের অভিযানে অনেক গাড়ি ডাম্পিং ও রেকার করা হয়েছে।

বিআরটিএর উপপরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. হেমায়েত উদ্দিন বলেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিআরটিএ একসঙ্গে কাজ করছে।

মিরপুর, পল্লবী, মহাখালী, রামপুরা, বাড্ডা, মালিবাগ, গুলিস্তান, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাব মোড়, সায়েদাবাদসহ রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় লক্কড়ঝক্কড় বাস চলতে দেখা যায়। দেখা যায়, যাত্রী তোলার জন্য প্রতিযোগিতাও।

রামপুরায় আরিফুর রহমান নামের এক যাত্রী জানান, যাত্রী নেওয়ার প্রতিযোগিতায় টিভি সেন্টারের কাছে কয়েক দিন আগে ভিক্টর পরিবহনের দুটি বাসের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়েছে। এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতা যাত্রী ও পথচারীদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রাজধানীতে ফিটনেসবিহীন বাস রয়েছে অনেক। লক্কড়ঝক্কড় বাস ও বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনার শিকার হতে হয় নগরবাসীকে। ফিটনেসবিহীন বাস ও প্রতিযোগিতা বন্ধে বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সরওয়ার বলেন, ফিটনেসবিহীন ও লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি যাতে রাস্তায় না নামে, সে জন্য বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশ যৌথভাবে কাজ করছে। লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

নিয়ম না মেনে লাইসেন্স ও ফিটনেস সনদ দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায় আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার। তিনি বলেন, যে প্রক্রিয়ায় ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়, সেই ব্যবস্থাই তো ঠিক নেই। এ কারণে রাজধানীর সড়কে বিশৃঙ্খলা।