শিরোনাম

ভোটের আগে সর্বভারতীয় বৈঠকে আরএসএস, নজর পশ্চিমবঙ্গ-পাঞ্জাবে

ভোটের আগে সর্বভারতীয় বৈঠকে আরএসএস, নজর পশ্চিমবঙ্গ-পাঞ্জাবে

ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সর্বভারতীয় সমন্বয় বৈঠক আজ শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে রাজস্থানের যোধপুরে। এ বৈঠক আগামী রোববার পর্যন্ত চলবে। বিজেপির আদর্শগত চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত এই সংগঠনের এ সম্মেলনে উপস্থিত রয়েছেন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত, সরকার্যবাহ দত্তাত্রেয় হোশবোলে এবং সংঘের প্রথম সারির নেতৃত্ব। সংঘের ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত মোট ৩২টি সংগঠনও এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যোগ দিয়েছে।

এই সম্মেলনের মূল এজেন্ডায় তিনটি অঞ্চল বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে—পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্ব ভারত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই রাজ্যগুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগের কারণ হলো, পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের দীর্ঘ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিজেপি এখনো ভোটের ময়দানে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করতে পারেনি। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের, যেখানে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে অমিত শাহ পর্যন্ত বারবার সফর করেছেন, ব্যাপক প্রচার সত্ত্বেও বিজেপি প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি। পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব সামাজিক কাঠামো, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বাঙালি জাতিসত্তার প্রশ্নে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই কারণেই আরএসএস এই রাজ্যটিকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বাধ্য হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচনের আগে ‘বঙ্গ সফর’ পরিকল্পনা নিয়েই বৈঠকে বিশদ আলোচনা চলছে। সূত্র বলছে, সংঘের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা এবার জেলায় জেলায় ঘুরে সাংগঠনিক রিপোর্ট তৈরি করবেন। একই সঙ্গে, তারা বাঙালি পরিচয়, ভাষা-সংস্কৃতি, এমনকি নির্বাচন কমিশনের বিশেষ ভোটার তালিকা সংশোধনী (এসআইআর) নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন, সেটিও খতিয়ে দেখবেন। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকা সংশোধনকে ঘিরে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছে যে এই উদ্যোগ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি পরিচয়কে আঘাত করছে। এই ইস্যুকে বিজেপি ও আরএসএস কতটা কাজে লাগাতে পারে, সে প্রশ্ন নিয়েও বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা চলছে।

আরএসএসের রাজনৈতিক দর্শন হলো হিন্দুত্ববাদ, যা প্রায়শই ভারতের সংবিধানের বহুত্ববাদী চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদিও বিজেপি সরকার সরাসরি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে না, বরং তারা উন্নয়ন ও জাতীয়তাবাদকে সামনে রাখে। তবে আরএসএসের বৈঠক থেকে আসা বার্তা প্রায়ই বিজেপির নির্বাচনী কৌশলে প্রতিফলিত হয়। অতীতে যেমন উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে আরএসএসের প্রচার যাত্রা ও সাংগঠনিক তৎপরতা বিজেপির নির্বাচনী সাফল্যের পথ সুগম করেছে, পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বামপন্থার দীর্ঘ ইতিহাস, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শক্তিশালী জনভিত্তি এবং বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব গর্ব বারবার আরএসএসকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

২০১৬ সাল থেকে আরএসএস পশ্চিমবঙ্গের তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। ২০২১ সালের ভোটের আগে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, এমনকি দক্ষিণ ভারতের রাজ্য থেকে প্রশিক্ষিত স্বয়ংসেবকেরা পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত জেলায় গিয়ে সংগঠন বিস্তারের চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময়েই আরএসএসের অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে নেতৃত্ব বলেছিল যে বিজেপির ২০০ আসন জয়ের দাবি বাস্তবসম্মত নয়। শেষ পর্যন্ত বিজেপি ৭৭টি আসনেই সীমাবদ্ধ হয়। এবারও আরএসএস নেতৃত্ব বলছে, অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা না দেখিয়ে সাংগঠনিক ভিত্তি শক্ত করার ওপর জোর দিতে হবে।

আলোচনার কেন্দ্রে পাঞ্জাবও রয়েছে। কৃষক আন্দোলনের পর পাঞ্জাবে বিজেপির সাংগঠনিক ভিত্তি আরও দুর্বল হয়েছে। শিখ অধ্যুষিত এ রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী বার্তা কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। আর উত্তর-পূর্ব ভারতে নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং এনআরসি নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে। ফলে এই তিনটি অঞ্চলে বিজেপির রাজনৈতিক অগ্রগতি কোথায় গিয়ে থেমে আছে, তা নির্ধারণ করাই যোধপুর বৈঠকের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

সামনে আরএসএসের শতবর্ষ উদ্‌যাপন। আগামী ২ অক্টোবর বিজয়া দশমীর পরই এক সপ্তাহ ধরে দেশজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হবে। সেই কর্মসূচির কেন্দ্রীয় ভাষণ দেবেন মোহন ভাগবত। রাজনৈতিক মহল কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে সেই ভাষণের দিকে। সম্প্রতি বিজেপির ভেতরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অবসর প্রসঙ্গ ঘিরে যে জল্পনা তৈরি হয়েছিল, ভাগবত অবশ্য তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ফলে এবারের বিজয়া দশমীর ভাষণে মোদির ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গ তোলার সম্ভাবনা নেই। বরং হিন্দুত্ববাদী দর্শন ও ভারতের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা নিয়েই তিনি কথা বলবেন।

পশ্চিমবঙ্গের ভোটের প্রাক্কালে এই বৈঠক নতুন কোনো বার্তা দেয় কিনা, সেটিই এখন দেখার বিষয়। বিজেপি কি বহুত্ববাদী ভারতের পথে এগোতে চায়, নাকি আরএসএসের চাপেই হিন্দুত্ববাদের দিকেই যাবে, সেটাই এখন আসল প্রশ্ন। আরএসএসের যোধপুর বৈঠক তাই কেবল একটি অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক বৈঠক নয়, ভারতের গণতন্ত্রের বহুত্ববাদ বনাম একরৈখিক হিন্দুত্ববাদ বিতর্কের প্রতিফলন হিসেবেও গুরুত্ব পাচ্ছে।


ক্রাইম জোন ২৪

আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button