একটি সমাজ—যেখানে অন্যায়, বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলার জয়জয়কার, সেখানে সত্য, ন্যায় ও মানবতার আলো জ্বলে ওঠা কঠিন। তবু মাঝে মাঝে কিছু সৎ মানুষের উদ্যোগে সমাজের রং পাল্টে যায়। অন্ধকার ভেদ করে সেখানে স্নিগ্ধ আলো ফুটে ওঠে। অশান্ত পরিবেশ রূপান্তরিত হয় শান্তির আলোকবর্তিকায়। মক্কার ইতিহাসের এমন এক আলোকিত অধ্যায়ের নাম হিলফুল ফুজুল।
আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে, যখন আরবের সমাজগুলো গোত্রীয় দম্ভ, অহংকার ও জাহিলি প্রথায় আচ্ছন্ন, ঠিক তখন হিলফুল ফুজুল নামে ইতিহাসের প্রথম মানবিক সংগঠন যাত্রা আরম্ভ করে, যার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
নবীজির নবুওয়াতের পূর্বে মক্কা ছিল আরব উপদ্বীপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। ভোরের আলো ফুটতেই জমে উঠত সেখানকার হাটবাজার। দূর-দূরান্ত থেকে আগত ব্যবসায়ীরা পণ্য সাজিয়ে বসে থাকত। কাবা শরিফের কারণে এ শহর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক দিক থেকেও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আরবের বিভিন্ন গোত্র এখানে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য করত।
সব দিক থেকে এত তাৎপর্য বহন করা সত্ত্বেও সেই সমাজে আইনকানুন বলতে কিছু ছিল না। সবলদের অত্যাচারে দুর্বলরা নিষ্পেষিত হতো প্রতিনিয়ত। দূর-দূরান্ত থেকে আগত ব্যবসায়ীদের ছিল না কোনো নিরাপত্তা। তবু পেটের দায়ে কেউ কেউ এখানে এসে ব্যবসার ঝাঁপি খুলে বসত। দুর্বল মানুষ বা ভিনদেশি ব্যবসায়ী মক্কায় এসে যদি প্রতারণার শিকার হতো, তবে তার জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব।
ইয়েমেন থেকে আগত এক বণিক মক্কার বাজারে পণ্য বিক্রি করছিল। এ সময় স্থানীয় এক নেতা তার দোকান থেকে পণ্য কিনল কিন্তু মূল্য পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানাল। শত চেষ্টা-তদবির করেও বণিকের পক্ষে মূল্য আদায় করা সম্ভব হলো না।
অসহায় ব্যবসায়ী কাবা শরিফের সামনে দাঁড়িয়ে কবিতার মাধ্যমে তার আর্তনাদ প্রকাশ করল। সে গলা ফাটিয়ে বলল—‘হে কোরাইশবাসী! তোমাদের শহরে একজন বিদেশি এসে প্রতারণার শিকার হয়েছে। কারও কি সাহস নেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর?’
এই আর্তনাদ মক্কার কিছু সৎ মানুষের অন্তরে ঝড় তুলল। তারা বুঝতে পারল, যদি এই অন্যায় রুখে না দেওয়া যায়, তবে মক্কার মর্যাদা কলঙ্কিত হবে এবং এ সমাজ ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে চলে যাবে।
এ ঘটনার পর নবীজির চাচা জুবায়ের ইবনে আবদুল মুত্তালিব মক্কার গোত্রপ্রধানদের কাছে ছুটে যান। গোত্রপ্রধানদের নিয়ে মক্কার সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ নেতা আবদুল্লাহ বিন তাইমির ঘরে একটি বৈঠক আহ্বান করেন। সে বৈঠকে বনি হাশেম, বনি মুত্তালেব, বনি জোহরা, বনি তাইম ও বনি আসাদ অংশ নেয়। ২৫ বছর বয়সী তরুণ মুহাম্মদ ওই বৈঠকে কিছু কল্যাণকর, বুদ্ধিদীপ্ত ও কার্যকরী প্রস্তাব পেশ করেন। সর্বসম্মতিক্রমে সেদিন চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
সেগুলো হলো—
১. আমরা ভিনদেশি মুসাফিরদের হেফাজত করব।
২. সম্মিলিতভাবে জালেমদের প্রতিহত করব।
৩. দুর্বল অসহায় ও নিঃস্বদের সহযোগিতা করব।
৪. সমাজ থেকে সব ধরনের অশান্তি দূর করব। এ বৈঠকের মাধ্যমেই গঠিত হয় মানবতার প্রথম সামাজিক সংগঠন। কুরাইশরা কল্যাণকামী এ সংঘের নাম দেয় হিলফুল ফুজুল তথা কল্যাণকামীদের সংগঠন।
হিলফুল ফুজুল সংগঠিত হওয়ার পরপরই মক্কার সে জালেম নেতা থেকে বণিকের প্রাপ্য উশুল করে তার হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। এর পর থেকে বিশৃঙ্খল মক্কা নগরীতে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে।
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুস সুন্নাহ রাজাবাড়ী, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।
ক্রাইম জোন ২৪
ঠিকানা: ১১৮ হাবিব ভবন ৪র্থ তলা, বিবিরপুকুর পশ্চিম পাড়, বরিশাল-৮২০০
মোবাইল: 01713956574, 01712445776 ইমেইল: [email protected]