শিরোনাম

ক্ষমা চেয়ে রাজসাক্ষীর জবানবন্দিতে যা যা বললেন সাবেক আইজিপি মামুন

ক্ষমা চেয়ে রাজসাক্ষীর জবানবন্দিতে যা যা বললেন সাবেক আইজিপি মামুন

জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে সারা দেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন তিনি। আজ মঙ্গলবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ তাঁর জবানবন্দি নেওয়া হয়। তাঁকে নিয়ে এ মামলায় ৩৬ জন সাক্ষ্য দিলেন।

জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, ‘আমার ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। আমাকে প্রথমে দেড় বছর এবং পরে আরও এক বছর আইজিপি হিসেবে এক্সটেনশন দেওয়া হয়। আইজিপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক গ্রুপিং ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক রাজনৈতিক মেরুকরণ হয় এবং গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক বলয় তৈরি হয়। পুলিশ অফিসারেরা বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে এবং সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে পড়ে। এসব কারণে সিনিয়র অফিসারদের পক্ষে পুলিশকে কন্ট্রোল করার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে।’

চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় আমি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ছিলাম। তখন আইজিপি ছিলেন জাবেদ পাটোয়ারী। আমি জানতে পারি, তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ৫০% ব্যালট ভর্তি করে রাখার পরামর্শ দেন। সরকারের পক্ষ থেকে সে মোতাবেক ডিসি, এসপি, ইউএনও, এসিল্যান্ড, ওসি ও দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সহযোগিতায় তা বাস্তবায়ন করা হয়। আর যেসব পুলিশ কর্মকর্তা এসব নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করে, তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপিএম ও পিপিএম পদক প্রদানের মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পুলিশে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায়। কিছু কিছু পুলিশ কর্মকর্তা প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তাদের ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্তৃপক্ষ ও রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল।’

চৌধুরী মামুন আরও বলেন, ‘তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় প্রায়ই রাতের বেলায় বৈঠক বসত এবং তা গভীর রাত পর্যন্ত চলত। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা ওইসব বৈঠকে অংশগ্রহণ করত, তাদের মধ্যে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবির অ্যাডিশনাল কমিশনার হারুন অর রশীদ, এসবির অ্যাডিশনাল আইজিপি মনিরুল ইসলাম, ঢাকার ডিআইজি নুরুল ইসলাম, অ্যাডিশনাল ডিআইজি বিপ্লব কুমার, অ্যাডিশনাল এসপি কাফি, ওসি মাজহার, ওসি ফরমান, ওসি অপূর্ব হাসানসহ আরও বেশ কিছু কর্মকর্তা ছিল। তাদের কারও কারও সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকার কারণে এসব পুলিশ কর্মকর্তা চেইন অব কমান্ড মানত না। কিন্তু আমি চাইতাম যে, তারা পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুক। প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে মূলত দুটি গ্রুপ ছিল। একটি গ্রুপের নেতৃত্বে ছিল তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং অন্য গ্রুপের নেতৃত্বে ছিল তৎকালীন এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম। তাঁরা চাইতেন তাঁদের নিজস্ব বলয়ের লোকজন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং পাক এবং ঢাকায় থাকুক।’

জবানবন্দিতে র‍্যাব নিয়ে যা বললেন সাবেক আইজিপি

চৌধুরী মামুন বলেন, ‘র‍্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় আমি জানতে পারি যে, র‍্যাবের হেডকোয়ার্টার কর্তৃক পরিচালিত উত্তরাস্থ র‍্যাব-১-এর কমপাউন্ডের ভেতরে টিএফআই সেল (টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেল) নামে একটি বন্দিশালা ছিল। অন্যান্য র‍্যাব ইউনিটের অধীনে আরও অনেকগুলো বন্দিশালা ছিল। এসব বন্দিশালায় রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী ও সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের আটক রেখে নির্যাতন করা হতো। যা একটি কালচারে পরিণত হয়েছিল। অপহরণ, গোপন বন্দিশালায় আটক, নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হত্যার মতো কাজগুলো র‍্যাবের এডিজি ও র‍্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকেরা সমন্বয় করতেন। র‍্যাব কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা, আটক রাখা কিংবা হত্যা করার নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত বলে শুনেছি। নির্দেশনাগুলো প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের মাধ্যমে আসত বলে জানতে পারি। এ নির্দেশনাগুলো চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে সরাসরি এডিজি (অপস) ও র‍্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের (র‍্যাব ইন্ট) পরিচালকদের কাছে পাঠানো হতো।’

চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘আমি র‍্যাবের ডিজি হিসেবে যোগদানের সময় আমার পূর্ববর্তী র‍্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ আমাকে জানান যে, টিএফআই সেলে ব্যারিস্টার আরমান বন্দী আছে। আমি যোগদানের পরে র‍্যাব ইন্টের ডাইরেক্টর লেফটেনেন্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেমও আমাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। র‍্যাবের এডিজি (অপস) ও র‍্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ (র‍্যাব ইন্ট) সাধারণত সেনাবাহিনীর অফিসার থেকে নিয়োগ করা হতো। টিএফআই সেলে ব্যারিস্টার আরমানের বন্দী থাকার বিষয়টি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সামরিক ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিকের নিকট একাধিকবার উপস্থাপন করি এবং এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানতে চাই। তিনি আমাকে পরে জানাবেন বলেন। কিন্তু পরে তিনি আর কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি। আমি র‍্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিয়ে আসার সময় পরবর্তী মহাপরিচালক খুরশীদ হোসেনকে ব্যারিস্টার আরমানের সম্পর্কে অবহিত করি।’

সাবেক আইজিপি আরও বলেন, ‘র‍্যাব কর্মকর্তাদের মধ্যে অ্যাডিশনাল এসপি আলেপ উদ্দিন ও এসপি মহিউদ্দিন ফারুকী নামের দুজন অফিসারকে আমি চিনতাম, যারা বন্দীদের অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার মতো কাজে বিশেষ পারদর্শী ছিল। আলেপ উদ্দিন প্রথমে নারায়ণগঞ্জে ছিল। পরে তাকে র‍্যাব ইন্টেলে পদায়ন করা হয়। আমি র‍্যাব ডিজির দায়িত্ব পালনের সময় র‍্যাবের ডাইরেক্টর ইন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম, লে. কর্নেল খাইরুল ইসলাম ও লে. কর্নেল মশিউর রহমান। এ ছাড়া এডিজি (অপস) হিসেবে দায়িত্ব পালন করে কর্নেল তোফায়েল, কর্নেল আজাদ ও কর্নেল কামরুল। আমার দায়িত্ব পালনকালে যদিও আমি র‍্যাব কর্তৃক মানুষকে বিনা বিচারে আটক, নির্যাতন ও কাউকে কাউকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার মতো বিষয়গুলো জানতাম। কিন্তু আমি কোনো তদন্ত করিনি বা এগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্তগুলো বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আসত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে চেইন অব কমান্ড মানা হতো না।’

জুলাই আন্দোলনে হত্যাকাণ্ড

চৌধুরী মামুন বলেন, ‘গত বছর জুলাই আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দেশব্যাপী সেনা মোতায়েন হয়। এরপর ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতেই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ধানমন্ডির সরকারি বাসায় কোর কমিটির মিটিং হতো। সেখানে আমাদের আন্দোলন দমনসহ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হতো। কোর কমিটিতে আমিসহ সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) টিপু সুলতান, অতিরিক্ত সচিব রেজা মোস্তফা, এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ, র‍্যাব ডিজি ব্যারিস্টার হারুনুর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, আনসারের ডিজি মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক, এনটিএমসির প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, ডিজিএফআইয়ের প্রধান ও এনএসআই প্রধানেরা উপস্থিত থাকতেন।’

সাবেক আইজিপি বলেন, ‘কোর কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটক করার সিদ্ধান্ত হয়। ডিজিএফআই ওই প্রস্তাব দেয়। আমি বিরোধিতা করেছিলাম। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে আমি রাজি হই। ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডিজিএফআই ও ডিবি তাদের আটক করে ডিবি হেফাজতে নিয়ে আসে। তাদের ডিবি হেফাজতে এনে আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আপস করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। তাদের আত্মীয়স্বজনকেও ডিবিতে নিয়ে এসে চাপ দেওয়া হয়। সমন্বয়কদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে টেলিভিশনে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়। এ ব্যাপারে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ডিবিপ্রধান হারুনকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘‘জিন’’ বলে ডাকতেন। কারণ, সে সরকারের নির্দেশনা পালনে পারদর্শী ছিল। আন্দোলনের একপর্যায়ে হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নজরদারি, তাদের অবস্থান নির্ণয় ও গুলি করে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করা হয়। হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। যার পরামর্শ দিয়েছিলেন তৎকালীন র‍্যাবের মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদ। পরে আন্দোলন দমনে সরাসরি লেথাল উইপন ব্যবহার করে এবং আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলো ভাগ করে ব্লকরেইড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’

মামুন বলেন, ‘১৮ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমাকে ফোন করে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলন দমনে সরাসরি লেথাল উইপন ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। তখন আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত ছিলাম এবং আমার সামনে অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় জোয়ার্দার উপস্থিত ছিলেন। আমি প্রলয় জোয়ার্দারকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানালে তিনি রুম থেকে বের হয়ে ডিএমপি কমিশনারসহ সারা দেশে এই নির্দেশনা পৌঁছে দেন। ওই দিন থেকে লেথাল উইপন ব্যবহার করা শুরু হয়। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান তাঁর অধীনস্ত কর্মকর্তাদের লেথাল উইপন ব্যবহারের নির্দেশনা দেন। লেথাল উইপন ব্যবহারের বিষয়ে অতি উৎসাহী ছিলেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল, যেকোনো মূল্যে আন্দোলন দমন করতে হবে।’

চৌধুরী মামুন বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মির্জা আযম, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন প্রধানমন্ত্রীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারে প্ররোচিত করতেন। সারা দেশে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে ১৫ জুলাই ওবায়দুল কাদের, নানক মন্তব্য করেন যে, আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রলীগ ও যুবলীগই যথেষ্ট। এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন পুলিশ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ড্রোন, হেলিকপ্টার ও লেথাল উইপন ব্যবহার করে আন্দোলনরত অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে আহত ও নিহত করা হয়। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্যাডার বাহিনী ছাড়াও আন্দোলন দমনে সরকারকে উৎসাহিত করে আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও ব্যবসায়ীরা।’

শেখ হাসিনার পদত্যাগ যেভাবে

চৌধুরী মামুন বলেন, ‘৪ আগস্ট বেলা ১১টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, এসবির প্রধান, ডিজিএফআইয়ের প্রধান, এনএসআইয়ের প্রধানসহ মোট ২৭ জন। আমি নিজেও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম। ওই বৈঠকে আন্দোলন দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরিস্থিতির রিপোর্ট পেশ করছিল। ইতিমধ্যে চারদিকে পরিবেশ-পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হওয়ায় বৈঠকটি মুলতবি করা হয়। ওই দিন রাতের বেলায় আমাদের আবার গণভবনে ডাকা হয়। সেখানে আমি, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র‍্যাবের ডিজি ও লে. জেনারেল মুজিব উপস্থিত ছিলাম। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর বোন শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন। ডিজিএফআইয়ের প্রধান ও এসবির প্রধান মনিরুল বাইরে অপেক্ষমাণ ছিলেন। বৈঠকে ৫ আগস্ট আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ‘‘মার্চ টু ঢাকা’’ কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে, পুলিশ ও সেনাবাহিনী সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করবে। এরপর আমরা আর্মির অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যাই। সেখানে আমি, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র‍্যাবের ডিজি, লে. জেনারেল মুজিব, ডিজিএফআইয়ের প্রধান ও এসবির প্রধান মনিরুল এবং ডিএমপি কমিশনার উপস্থিত ছিলাম। সেখানে ঢাকা শহরের প্রবেশমুখগুলোতে ফোর্স মোতায়েন করে কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।’

সাবেক আইজিপি বলেন, ‘৪ আগস্ট মিটিং শেষে রাত সাড়ে ১২টায় আমরা আর্মির অপারেশন কন্ট্রোল রুম থেকে চলে আসি। ৫ তারিখ সকালে আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আমার দপ্তরে যাই। ইতিমধ্যে উত্তরা, যাত্রাবাড়ী ও বিভিন্ন পথ দিয়ে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে শুরু করে। দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টার দিকে জানতে পারি, প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি কোথায় যাবেন, তা আমরা জানতাম না। এরপর বিকেলবেলা আর্মির হেলিকপ্টার এসে আমাদের পুলিশ হেডাকোয়ার্টার্স থেকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে এবং সেখান থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যায়। হেলিকপ্টারে আমার সঙ্গে এসবির প্রধান মনিরুল, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিআইজি আমেনা ছিলেন। পরের শিফটে অ্যাডিশনাল ডিআইজি প্রলয়, অ্যাডিশনাল আইজি লুৎফুল কবিরসহ অন্যদের সেখানে নেওয়া হয়। ৬ তারিখ আইজিপি হিসেবে আমার নিয়োগ চুক্তি বাতিল করা হয়। ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকালে ৩ সেপ্টেম্বর আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।’

চৌধুরী মামুনের ক্ষমাপ্রার্থনা

চৌধুরী মামুন বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকারের আদেশে আন্দোলনকারীদের ওপর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে তাদের আহত ও নিহত করায় আমি পুলিশপ্রধান হিসেবে লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাসহ ব্যাপক নৃশংসতার জন্য আমি অপরাধবোধে ও বিবেকের তাড়নায় অ্যাপ্রুভার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ট্রাইব্যুনালে এসে স্বজন হারানো ব্যক্তিদের কান্না, আহাজারি, চিকিৎসা প্রদানে বাধা দেওয়া-সংক্রান্ত ডাক্তার ও ভিকটিমদের বক্তব্য, ভিডিওতে নৃশংসতাগুলো দেখে অ্যাপ্রুভার হওয়ার সিদ্ধান্ত আরও যৌক্তিক মনে হয়েছে। বিশেষ করে, হত্যা করার পর লাশগুলো একত্র করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার বীভৎসতা আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে।’

মামুন আরও বলেন, ‘আমি সাড়ে ৩৬ বছর পুলিশে চাকরি করেছি। পুলিশের চাকরি খুবই ট্রিকি। সব সময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। চাকরি জীবনে আমার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ আসেনি। আমি সব সময় যথেষ্ট মানবিকতা ও সচেতনার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। চাকরিজীবনের শেষপর্যায়ে এসে এত বড় গণহত্যা আমার দায়িত্বকালে সংঘটিত হয়েছে, তার দায় আমি স্বীকার করছি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়। আমি গণহত্যার শিকার প্রতিটি পরিবার, আহত ব্যক্তিবর্গ, দেশবাসী ও ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’ এ সময় তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিবেন। আমার এই সত্য ও পূর্ণাঙ্গ বর্ণনার মাধ্যমে সত্য উদ্‌ঘাটন হলে আল্লাহ যদি আমাকে আরও হায়াত দান করেন, বাকি জীবন কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাব।’


ক্রাইম জোন ২৪

আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button