ইন্দোনেশিয়ায় সংসদ সদস্যদের ভাতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া বিক্ষোভ এখন ভয়াবহ সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। রাজধানী জাকার্তা থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম জাভা থেকে শুরু করে বালি ও লোম্বক দ্বীপ পর্যন্ত। এতে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে সাতজন নিহত হয়েছেন, অগ্নিকাণ্ড ও লুটপাটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য সরকারি ভবন ও রাজনীতিকের বাড়ি।
বিক্ষোভের সূত্রপাত
গত আগস্টে স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, ইন্দোনেশিয়ার সংসদ সদস্যরা মাসে প্রায় ১০ কোটি রুপিয়া (প্রায় ৭ লাখ ৩২ হাজার টাকা) বেতন-ভাতা পাচ্ছেন, যা দেশটির গড় আয়ের ৩০ গুণেরও বেশি। এর মধ্যে ছিল বিশাল অঙ্কের আবাসন ভাতাও। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির চাপে দিশেহারা। সরকারের কৃচ্ছ্রসাধনের সময় সংসদ সদস্যদের বিলাসবহুল সুবিধা বৃদ্ধির খবর জনরোষকে বিস্ফোরিত করে।
প্রতিবাদে গত ২৫ আগস্ট জাকার্তায় প্রথম বড় সমাবেশ হয়। বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল সংসদ সদস্যদের ভাতা পুনর্বিবেচনা ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু ধীরে ধীরে আন্দোলন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে।
আগুনে ঘি ঢালল এক মৃত্যু
গত বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) রাতে পুলিশের গাড়িচাপায় নিহত হন ২১ বছর বয়সী মোটরবাইক ডেলিভারি চালক আফফান কুরনিয়াওয়ান। এই ঘটনায় দেশের প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো ও পুলিশের প্রধান প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করলেও জনরোষ আরও ছড়িয়ে পড়ে। আফফানের মৃত্যু যেন অব্যবস্থাপনা, বৈষম্য ও পুলিশি জবাবদিহির প্রশ্নকে আরও স্পষ্ট করে তুলল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু ভাতা নয়—দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য ও ধনী-গরিবের ব্যবধানই মানুষের ক্ষোভকে প্রবল করেছে। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভেদি হাদিজ বলেছেন, ‘রাজনীতিকদের বিলাসী জীবনযাপন সাধারণ মানুষের ন্যায্যতার বোধকে আঘাত করেছে।’
সরকারের পদক্ষেপ ও দ্বিমুখী প্রতিক্রিয়া
ডেলিভারি চালকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ সহিংস রূপ নেওয়ায় প্রেসিডেন্ট প্রাবোও গত রোববার (৩১ আগস্ট) ঘোষণা দেন, সংসদ সদস্যদের কিছু ভাতা কমানো হবে। তবে বিক্ষোভকারীরা বলছেন, এটি সামান্য এবং লোক দেখানো উদ্যোগ; মূল সমস্যার সমাধান হয়নি। ছাত্রনেতা হেরিয়ান্তো মন্তব্য করেন, ‘এটি সঠিক পথে একটি পদক্ষেপ। কিন্তু কৃষি নীতি, শিক্ষা বা ন্যায়সংগত অর্থনৈতিক সুযোগের মতো বড় প্রশ্নগুলো এখনো রয়ে গেছে।’
একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট প্রাবোও নিরাপত্তা বাহিনীকে কড়া হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশ দেন। ইতিমধ্যে কয়েকটি আঞ্চলিক সংসদ ভবনে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। মাকাসারে একটি ভবনে আগুন লেগে অন্তত তিনজনের মৃত্যু হয়। জাকার্তায় কয়েকজন এমপির বাড়ি লুট হয়। এ অবস্থায় রাজধানীতে তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে, মোতায়েন করা হয়েছে সেনা ও স্নাইপার।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
প্রেসিডেন্ট প্রাবোওর নেতৃত্বের জন্য এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ২০২৪ সালে ক্ষমতায় আসা সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সামাজিক মাধ্যমে নরম ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু তাঁর অতীত ও বর্তমান পদক্ষেপ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে শঙ্কা আছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই আন্দোলন ইন্দোনেশিয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোর যে কোনো প্রতিবাদের তুলনায় গভীর ও ব্যাপক। মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ জমে ছিল, আফফানের মৃত্যু সেটিকেই বিস্ফোরিত করেছে। পরিস্থিতি শান্ত হবে নাকি আরও সহিংসতায় রূপ নেবে, তা নির্ভর করছে সরকারের সংলাপ ও সংস্কারমুখী পদক্ষেপের ওপর।
ছাত্রনেতা হেরিয়ান্তোর ভাষায়, ‘এই মুহূর্ত হতে পারে এক মোড় পরিবর্তনের সূচনা। শাসকগোষ্ঠী যদি সত্যিই জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, তবে পরিবর্তনের পথ খুলবে। আর যদি দমন-পীড়নকে বেছে নেয়, তবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিই ঘটবে।’
ক্রাইম জোন ২৪
ঠিকানা: ১১৮ হাবিব ভবন ৪র্থ তলা, বিবিরপুকুর পশ্চিম পাড়, বরিশাল-৮২০০
মোবাইল: 01713956574, 01712445776 ইমেইল: [email protected]