আদালত অবৈধ ঘোষণার পর ট্রাম্পের শুল্কের ভবিষ্যৎ কী


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফেডারেল আপিল আদালত রায় দিয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা অধিকাংশ শুল্কই প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর জরুরি ক্ষমতার এখতিয়ারের বাইরে বা অতিরিক্ত ব্যবহার। গত শুক্রবার আদালত জানায়, প্রায় সব দেশের ওপর আরোপিত তথাকথিত ‘রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ বা পাল্টাপাল্টি শুল্ক’ অবৈধভাবে আরোপ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে গত মে মাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালতও একই সিদ্ধান্ত দেয়। আদালত সে সময় জানায়, ট্রাম্প বৈশ্বিক শুল্ক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইনের অধীনে অনুমোদিত বলে যুক্তি দেখিয়ে যে শুল্ক আরোপ করেছেন, তা ঠিক নয়।
তবে মার্কিন ফেডারেল আপিল আদালত এখনো শুল্ক বাতিল করেনি। রায়ে বলা হয়েছে, এসব শুল্ক অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বহাল থাকবে। এরপর বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে তোলা হবে। এখনো অনেক কিছু স্পষ্ট নয়। তবে এতটুকু বোঝা যাচ্ছে, এ রায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অন্যতম প্রধান নীতির জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আপিল আদালত কী বলেছে?
আদালতের ১১ জন বিচারকের মধ্যে সাতজন নিম্ন আদালতের রায়কে সমর্থন করেন। নিম্ন আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল, ট্রাম্প বৈশ্বিক শুল্ক আরোপের ক্ষমতা রাখেন না। চারজন বিচারক এই অবস্থানের বিরোধিতা করেন। ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে আইনকে তাঁর শুল্কনীতি বাস্তবায়নের ভিত্তি করেছিলেন, সেটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিচারকেরা শুল্ক আরোপের বিষয়টিকে অবৈধ বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ইমারজেন্সি ইকোনমিক পাওয়ারস অ্যাক্টের (আইইইপিএ) ব্যাখ্যায় বিচারকেরা বলেন, এ আইনে শুল্ক, কর বা সেরকম কিছু আরোপের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি প্রেসিডেন্টকে।
আর এ এ কারণেই মার্কিন আপিল আদালত ট্রাম্পের যুক্তি খারিজ করে দেয়। আদালত রায়ে বলেছে, এই শুল্ক ‘আইনের পরিপন্থী হওয়ায় অবৈধ।’ রায় ঘোষণার পরপরই ট্রাম্প তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। রায় ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, আপিল আদালত ‘চরম পক্ষপাতদুষ্ট’ এবং এই রায় দেশের জন্য ‘বড় বিপর্যয়’। তিনি আরও লেখেন, ‘যদি এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকে, তাহলে তা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেবে।’
আইইইপিএ কী?
দীর্ঘ কয়েক দশক আগে প্রণীত ইন্টারন্যাশনাল ইমারজেন্সি ইকোনমিক পাওয়ারস অ্যাক্ট (আইইইপিএ) আইনটি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর দুই দফায় ক্ষমতায় থাকার সময় বারবার ব্যবহার করেছেন। আইইইপিএ প্রেসিডেন্টকে উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা দেয়, যাতে তিনি জাতীয় জরুরি অবস্থা বা বিদেশ থেকে আসা বড় ধরনের হুমকির জবাব দিতে পারেন।
১৯৭৭ সালে প্রণীত এই আইনে বলা আছে, প্রেসিডেন্ট বিভিন্ন অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিতে পারবেন, যদি এমন কোনো ‘অস্বাভাবিক ও গুরুতর হুমকি’ তৈরি হয়, যা পুরোপুরি বা আংশিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থেকে আসে এবং তা দেশের জাতীয় নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতি বা অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ হয়।
আইনটি সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও জো বাইডেনও ব্যবহার করেছেন। ২০১৪ সালে রাশিয়া অবৈধভাবে ক্রিমিয়া দখল করলে ওবামা এই আইনের মাধ্যমে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। আট বছর পর রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় হামলা চালালে বাইডেন একই আইন ব্যবহার করে আবার নিষেধাজ্ঞা দেন।
তবে আপিল আদালত রায়ে জানিয়েছে, এই জরুরি আইন প্রেসিডেন্টকে শুল্ক আরোপের মতো ব্যাপক ক্ষমতা দেয় না। আদালত বলেছে, আইইইপিএতে কোথাও ‘শুল্ক’ (বা এর সমার্থক কোনো শব্দ) উল্লেখ নেই এবং এমন কোনো প্রক্রিয়াগত শর্তও নেই, যা প্রেসিডেন্টকে শুল্ক আরোপের সীমা নির্ধারণ করে দেয়।
তবে ট্রাম্প যুক্তি দিয়েছিলেন, বৈশ্বিক বাণিজ্য ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর। তাই এটিকে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে তিনি বৈশ্বিক শুল্ক আরোপ করেছিলেন। কিন্তু আদালত রায়ে জানায়, শুল্ক আরোপ প্রেসিডেন্টের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না এবং ‘অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা (যার মধ্যে কর আরোপও অন্তর্ভুক্ত) কংগ্রেসের হাতে ন্যস্ত।’
এ রায় এত গুরুত্বপূর্ণ কেন
ট্রাম্পের এজেন্ডার অন্যতম প্রধান পরিকল্পনায় বড় ধরনের ধাক্কা দেওয়ার পাশাপাশি ফেডারেল আপিল আদালতের এই রায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলতে পারে। এর ধারাবাহিক প্রভাব বিশ্ববাজারেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
শুল্ক আসলে একধরনের কর, যা বিদেশ থেকে নির্দিষ্ট পণ্য আমদানির সময় কোম্পানিগুলোকে দিতে হয়। ফলে এগুলো বিক্রি এবং লাভের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন বিজনেস স্কুলের অর্থনীতিবিদ ড. লিন্ডা ইউহ বিবিসি রেডিও ফোরের টুডে অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।’
শুল্ক আরোপের উদ্দেশ্য হলো দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশি পণ্য কেনা থেকে নিরুৎসাহিত করা, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে প্রভাবিত করে। এখন দেশগুলো অপেক্ষা করছে, যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট মামলাটি গ্রহণ করবে কি না, যা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এ সময়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করা থেকে বিরত থাকতে পারে।
ড. ইউহের মতে, এমন হলে তা ‘অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে স্থবির করে দিতে পারে।’ এ ছাড়া রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়তে পারে। যেমন—যদি সুপ্রিম কোর্ট ফেডারেল আপিল আদালতের রায় উল্টে দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষে দাঁড়ায়, তাহলে এটি এমন একটি নজির তৈরি করবে, যা প্রেসিডেন্টকে আইইইপিএ আইন আরও আক্রমণাত্মকভাবে ব্যবহার করতে উৎসাহিত করবে।
এরপর কী?
এখন মামলাটি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতে গড়ানোর সম্ভাবনাই বেশি। ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে শেয়ার করা এক পোস্টে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, জনগণের প্রতি ‘অযত্নশীল ও অজ্ঞ রাজনীতিবিদেরা আমাদের বিরুদ্ধে শুল্ক ব্যবহার করতে দিয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের সহায়তায় আমরা সেগুলো আমাদের দেশের কল্যাণে ব্যবহার করব এবং আমেরিকাকে আবারও ধনী, শক্তিশালী ও ক্ষমতাশালী করে তুলব!’
যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীল বিচারপতিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় প্রেসিডেন্টের অবস্থানকে সমর্থন করার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি। নয় বিচারপতির মধ্যে ছয়জন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টদের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। তাঁদের মধ্যে তিনজনকে নিয়োগ দিয়েছিলেন ট্রাম্প নিজেই, তাঁর প্রথম মেয়াদকালে।
তবে আদালত একই সঙ্গে প্রেসিডেন্টদের সমালোচনাও করেছে। বিচারকেরা সতর্ক করে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট কংগ্রেস অনুমোদিত ক্ষমতার বাইরে গিয়ে নীতি প্রয়োগের চেষ্টা করছেন। উদাহরণস্বরূপ, জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে আদালত ‘মেজর কোয়েশ্চনস ডকট্রিনকে’ আরও প্রসারিত করে। এর মাধ্যমে বিদ্যমান আইন ব্যবহার করে ডেমোক্র্যাটদের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন সীমিত করার উদ্যোগ ও কোটি কোটি আমেরিকানের শিক্ষাঋণ মওকুফের পরিকল্পনা বাতিল করে দেয় আদালত।
শুল্ক অবৈধ ঘোষণা হলে কী হবে?
ফেডারেল আপিল আদালত ৭-৪ ভোটের রায়ে জানিয়েছে, ট্রাম্পের প্রায় সর্বজনীন শুল্ক আরোপ ‘অবৈধ।’ এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার জন্য। এই মামলার রায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এবং বিশ্বের বাকি দেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
যদি সুপ্রিম কোর্ট আপিল আদালতের রায় বহাল রাখে, তাহলে বাজারে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমদানি শুল্ক থেকে যে কয়েক বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা হয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরত দিতে হবে কি না।
এ ছাড়া বড় অর্থনীতির দেশগুলো যেমন—যুক্তরাজ্য, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া যেসব দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করেছে, সেগুলোও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে। এমনকি যেসব বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে, সেগুলোও অচলাবস্থায় পড়তে পারে।
আপিল আদালতের রায় বহাল থাকলে তা ট্রাম্পের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এবং ‘ডিলমেকার’ হিসেবে তাঁর খ্যাতির জন্য বড় ধাক্কা হবে। তবে যদি সুপ্রিম কোর্ট রায় উল্টে দেয়, তাহলে তার বিপরীত প্রভাব পড়বে।
ক্রাইম জোন ২৪