রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, অফিস সহকারী ও দুই সহকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে পাঁচ মাস আগে সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও বর্তমানে সহকারী প্রধান শিক্ষক আখতারুজ্জামান ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে বলে দাবি করা হলেও আসলে কোনো কমিটি করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১০ জুন প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন আব্দুল খালেক। যোগদানের পর থেকেই তিনি সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধিক হারে সেশন ফি, বেতন ও পরীক্ষার ফি বাবদ প্রায় ১৩ লাখ টাকা আদায় করেন। এর মধ্যে পরীক্ষার খরচ দেখানো হয় মাত্র ৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া উপবৃত্তিধারী শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতনের সরকারি বরাদ্দ থেকে ৫ লাখ ১২ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ লাখ ১২ হাজার টাকা বিভিন্ন অজুহাত ও ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক অফিস সহকারী কাজী শওকত আলী এবং দুই সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন ও প্রিয়নাথ রায়ের যোগসাজশে আত্মসাৎ করেন।
সম্প্রতি অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির গ্রামীণ ব্যাংক গজঘণ্টা শাখার স্কুল শাখা (হিসাব নম্বর-১০০০০১) ও কলেজ শাখা (হিসাব নম্বর-১০০০০২) থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট মাস থেকে ২০২৫ সালের ১ আগস্ট পর্যন্ত কোনো লেনদেন হয়নি। কিন্তু রংপুর মেডিকেল কলেজ শাখার অগ্রণী ব্যাংকের হিসাব থেকে ৫ লাখ ১২ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিতে গেলে কথা হয় সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও বর্তমান সহকারী প্রধান শিক্ষক আখতারুজ্জামানের সঙ্গে। অতিরিক্ত সেশন ফি ও বেতন আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি অধ্যক্ষ সাহেবকে বারবার নিষেধ করেছিলাম। এমনকি মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রও দিয়েছিলাম; কিন্তু তিনি শোনেননি। বরং আমাকে বলেছিলেন, আপনার এসব বিষয়ে নাক গলানোর দরকার নেই। আমার জানা মতে, দেড় বছরে দুটি পরীক্ষার জন্য ৩ লাখ টাকা খরচ করেছেন। বাকি টাকা কোথায় গেছে, তার কোনো হিসাব নেই।’
আখতারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারি বিধি অনুযায়ী স্কুলের অর্থ কমিটির আহ্বায়ক হওয়ার কথা আমার। কিন্তু আর্থিক অনিয়ম করার জন্য তিনি (অধ্যক্ষ) নিজের পছন্দমতো দুই শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন ও প্রিয়নাথ রায়কে নিয়ে দায়সারা কমিটি চালিয়েছেন। প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও আমাকে কোনো কাজে সম্পৃক্ত করা হয়নি।’
অতিরিক্ত সেশন ফি ও বেতন আদায়ের বিষয়ে লাল মিয়া, সাজু মিয়াসহ অন্তত ১৮-২০ জন উপবৃত্তিধারী শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, ‘আমরা জানতামই না উপবৃত্তিধারী বাচ্চাদের বেতন সরকার দেয়। আমরা দিনমজুর মানুষ। এবারের পরীক্ষার সময় কয়েকজন অভিভাবকের টাকা জোগাড় করতে সমস্যা হয়েছিল। প্রধান শিক্ষকের কাছে ফি কমানোর অনুরোধ করলে তিনি রাজি হননি।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘আখতারুজ্জামান নিজেই কমিটি করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তিনি তাঁর ভায়রাকে দিয়ে রিট করান। ফলে কমিটি দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পরে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আমাদের বলেন, “আপনারা নিজের মতো খরচ করে হিসাব রাখুন।” তাই আমরা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে খরচ করেছি। তবে উপবৃত্তিধারী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন বা অতিরিক্ত ফি নেওয়া যাবে কি না, সেটা অধ্যক্ষই জানেন।’
অফিস সহকারী কাজী শওকত আলী বলেন, ‘প্রতিদিন যা টাকা ওঠে, সব আমি হেড স্যারকে বুঝিয়ে দিই। আমার কাছে কোনো টাকা থাকে না।’
অভিযুক্ত অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক বলেন, ‘যদি প্রতিষ্ঠানে কমিটি না থাকে তাহলে আমি টাকা ব্যাংকে রেখে কি বিপদে পড়ব? তাই ইউএনও ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের মৌখিক অনুমতি নিয়ে অফিস সহকারীর মাধ্যমে টাকা খরচ করি। সরকার থেকে উপবৃত্তিধারী শিক্ষার্থীদের বেতনের যে টাকা আসে, তা দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানো যায় না। তাই অতিরিক্ত ফি নিতে হয়।’ অন্য এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘উপবৃত্তিধারী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া যাবে না—এমন কোনো পরিপত্র আমার জানা নেই।’
এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আবু সাঈদ মো. আরিফ মাহমুদ বলেন, ‘অধ্যক্ষের দাবি ঠিক নয়। আর্থিক বিষয়ে মৌখিক নির্দেশ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। কাউকে এমন কিছু বলা হয়নি।’
ইউএনও মাহমুদুল হাসান মৃধা বলেন, ‘এ নিয়ে অভিযোগ পাওয়ার পরপরই আমরা তদন্ত কমিটি দিয়ে দিয়েছি। এ মুহূর্তে বলতে পারছি না, কাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে আমার অফিসের মমতাজ বিস্তারিত বলতে পারবে। অধ্যক্ষ নিজে অপরাধ করে এখন আমার ওপর দায় চাপিয়ে বাঁচতে চাচ্ছেন। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বললাম। উনি এখন কিছু বলতে পারছেন না। অধ্যক্ষ যে অপরাধ করেছেন তা আমার কাছে শিকার করেছেন। আমি তাঁকে বৃহস্পতিবার ঢেকেছি, উনি এলে আমি তাঁর কাছে থেকে তাঁর অপরাধের লিখিত নিয়ে নেব।’
জানতে চাইলে উপজেলা উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা মমতাজ বেগম বলেন, ‘যিনি এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন তিনি বলেছিলেন তদন্তটা কয়েক দিন পরে দেন। এ জন্যই তদন্তটা দেওয়া হয়নি।’
ক্রাইম জোন ২৪
ঠিকানা: ১১৮ হাবিব ভবন ৪র্থ তলা, বিবিরপুকুর পশ্চিম পাড়, বরিশাল-৮২০০
মোবাইল: 01713956574, 01712445776 ইমেইল: [email protected]