পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক চিত্র ভয়াবহ। ২৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে ১২টি প্রতিষ্ঠানই লোকসানে ডুবে গেছে, যার পরিমাণ ছাড়িয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। অপর দিকে মুনাফায় থাকা প্রতিষ্ঠান মাত্র ছয়টি, তবে তাদের মোট আয় ২০০ কোটির ঘরও পেরোয়নি। বাকি পাঁচ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণী এখনো প্রকাশিত হয়নি। সব মিলিয়ে খাতটির অবস্থা একেবারেই নাজুক।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই দুরবস্থার মূল কারণ দীর্ঘদিনের সুশাসনের অভাব এবং লাগামহীন অনিয়ম। মালিকপক্ষ, শীর্ষ নির্বাহী, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের যোগসাজশে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ লুট হয়েছে। এতে শুধু গ্রাহকের টাকা উধাও হয়নি, তীব্র তারল্যসংকটে পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোও। ফলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখন বিশেষ নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত আর্থিক চিত্র বের করা জরুরি। একই সঙ্গে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে তবেই খাতে আস্থা ফিরতে শুরু করবে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে লোকসানে থাকা ১২ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড, যার ক্ষতি হয়েছে শেয়ারপ্রতি ১৫ টাকা ৮৪ পয়সা করে মোট ২৬২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। দ্বিতীয় স্থানে থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লোকসান করেছে শেয়ারপ্রতি ৬ টাকা ৬২ পয়সা করে মোট ১৮৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। তৃতীয় স্থানে রয়েছে ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, যার ক্ষতি ১৪৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
চতুর্থ স্থানে থাকা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লোকসান করেছে ১৩৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা, আর পঞ্চম স্থানে থাকা প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স হারিয়েছে ৫৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
এ ছাড়া লোকসানের তালিকায় রয়েছে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান—ফারইস্ট ফাইন্যান্স ৫০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, মাইডাস ফাইন্যান্স ৪৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা, ফার্স্ট ফাইন্যান্স ৪৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা, বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ৪২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি ৩১ কোটি ৪১ লাখ টাকা, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ২৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা এবং ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পিএলসি ১৫ কোটি ১ লাখ টাকা লোকসান করেছে। সব মিলিয়ে লোকসানি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি ক্ষতির অঙ্কও ভয়াবহ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য ও বিশ্লেষক অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, প্রভাবশালীদের যোগসাজশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দিয়েছে নামমাত্র কোম্পানিকে, বিনিয়োগ করেছে প্রি-আইপিও শেয়ারে, যা বাজারে আসেনি। শীর্ষ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা লুটপাট করেছে, ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের মুখে। এখন চিত্র প্রকাশ পাওয়ায় ভয়াবহতা স্পষ্ট। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিশেষ নিরীক্ষা ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পদক্ষেপ জরুরি।
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) ভাইস চেয়ারম্যান কান্তি কুমার সাহা বলেন, যথাযথ ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, গ্রাহক বাছাই ও খেলাপি ঋণ নীতিমালা মেনে চলা হলে এই সংকট তৈরি হতো না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানলেই অনেক সমস্যা এড়ানো যেত।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মুনাফা করতে পেরেছে মাত্র ৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এদের সম্মিলিত মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১৭৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি লাভ করেছে আইডিএলসি ফাইন্যান্স, যার আয় ১০৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ডিবিএইচ ফাইন্যান্স পিএলসি, শেয়ারপ্রতি ২ টাকা ৭ পয়সা করে মোট ৪১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা মুনাফা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তৃতীয় স্থানে থাকা আইপিডিসি ফাইন্যান্স শেয়ারপ্রতি ৩৭ পয়সা করে ১৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা আয় করেছে। এ ছাড়া ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স ৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স পিএলসি ৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্স পিএলসি ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা মুনাফা করেছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবিব বলেন, এনবিএফআইগুলো স্বল্পমেয়াদি আমানতের ওপর ভর করে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিচ্ছে, ফলে সম্পদ ও দায়ের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের উচিত দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য বন্ড ইস্যু করে অর্থ জোগাড় করা।
প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি এমন ৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি, ইনেভস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ও উত্তরা ফাইন্যান্স।
ক্রাইম জোন ২৪
ঠিকানা: ১১৮ হাবিব ভবন ৪র্থ তলা, বিবিরপুকুর পশ্চিম পাড়, বরিশাল-৮২০০
মোবাইল: 01713956574, 01712445776 ইমেইল: [email protected]