‘বান হইলে যে ক্ষতি হয়, না হইলে আমগো এর চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। চরের জমিতে ধান, কলাই আর আগাম বাদাম ফলানো যায় না। এবার সময়মতো বান না হওয়ায় চরে এগুলা আবাদ করা যায় নাই। ধান না হইলে মাইনষের খাওনের কষ্ট হইব।’
বর্ষাকালে পর্যাপ্ত পরিমাণে মৌসুমি বৃষ্টি আর বন্যার দেখা না মেলায় কৃষির ক্ষতি নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জের কৃষক মতিয়ার।
একই রকম হতাশার কথা শোনান রাজিবপুর উপজেলার কৃষকনেতা শহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, সময়মতো বন্যা না হলে পলির অভাবে জমির উর্বরতা শক্তি থাকে না। ফলে ভালো আবাদ হয় না। আবার বিলম্বে হওয়া বন্যায় ক্ষতি হয়। এবার বর্ষাকালে বন্যা না হওয়ায় তাঁকে আমন চাষ নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে। যাঁরা পাট আবাদ করেছেন, তাঁরা পানির অভাবে জাগ দিতে পারছেন না। এখন আবার ভাদ্র-আশ্বিনে বন্যা হলে ফসল নষ্ট হয়ে খুব ক্ষতি হবে। কৃষির জন্য সময়মতো বন্যা লাগে।
শুধু মতিয়ার বা শহিদুল নন, জেলার আরও কয়েকজন কৃষক জানান, বন্যার সময় ও ধরনের পরিবর্তনে কৃষিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণেও এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, বৈশ্বিক আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যা ও বৃষ্টিপাতের পঞ্জিকায় এই পরিবর্তন এসেছে। গত কয়েক বছরে মৌসুমি বন্যার পরিবর্তে আকস্মিক বন্যার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, ব্রহ্মপুত্র, ধরলাসহ জেলার প্রধান নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে ২০২২ সালের জুনে ও ২০২৩ সালের জুন-জুলাই মাসে বন্যা হয়। ২০২৪ সালের জুন-জুলাইয়ে দুই দফা বন্যা শেষে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ফের বন্যা আঘাত হানে। তিন দফা বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে জেলার কৃষি ও মৎস্য খাত। কিন্তু ২০২৫ সালে আগস্টেও বন্যার দেখা মেলেনি। বৃষ্টিপাতের পরিমাণেও এসেছে পরিবর্তন। সময়মতো বন্যা ও বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষিতে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। চরাঞ্চলে আমন ও পাট চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, গত পাঁচ বছরে মৌসুমি বন্যার স্থলে আকস্মিক বন্যার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও ধরনে পরিবর্তন এসেছে। প্রধান নদী অববাহিকায় বড় বন্যার জন্য কয়েক সপ্তাহজুড়ে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। অল্প সময়ে অধিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তবে এই পরিবর্তন আবহাওয়া বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কি না, তা বুঝতে আরও কয়েক বছর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে হবে।
নদীতীরবর্তী অঞ্চলের কৃষকেরা বলছেন, বৃষ্টিপাতের আকস্মিক পরিবর্তন কৃষিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এর ফলে এ বছর তাঁরা সময়মতো ধান ও অন্যান্য ফসল চাষাবাদ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকে পানির অভাবে সেচ দিয়ে জমি চাষ করছেন আবার কেউবা জমি পতিত অবস্থায় ফেলে রেখেছেন।
চাষাবাদের উপযুক্ত সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং মৌসুমি বন্যার সময়ে পরিবর্তন আসাকে আবহাওয়া ও জলবায়ুর বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রভাব বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মুহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম বলেন, বিশ্বজুড়ে পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়ায় আবহাওয়ায় পরিবর্তন এসেছে। এর ফলে বৃষ্টিপাত ও বন্যার সময়ে পরিবর্তন এসেছে; যার প্রভাব পড়ছে কৃষিতে।
এ ক্ষেত্রে কৃষকদের করণীয় বিষয়ে উপাচার্য বলেন, কৃষিতে লেট ভ্যারাইটি (বিলম্বিত জাত) বাছাই করতে হবে। লেট ভ্যারাইটি কিন্তু ফলন ভালো হবে এমন জাত উদ্ভাবন করতে হবে। বন্যা-সহনশীল জাত উদ্ভাবন করে কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এই অঞ্চলের কৃষির সমস্যা নিয়ে গবেষণা করে কৃষির উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
এ নিয়ে কথা হলে কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ড. মো. মামুনুর রহমান বলেন, বিলম্বিত বন্যায় কৃষির অনেক ক্ষতি হয়। এ বছর জুলাই-আগস্টে বন্যা হয়নি। এ ছাড়া পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে কুড়িগ্রামে পাট চাষে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আবার সেপ্টেম্বরে বন্যা হলে কৃষির মারাত্মক ক্ষতি হবে। আগে থেকে পূর্বাভাস পেলে কৃষকদের প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হয়। সে ক্ষেত্রে কৃষকেরা বিকল্প হিসেবে উঁচু স্থানে আপৎকালীন বীজতলা তৈরি করে রাখতে পারেন।
ক্রাইম জোন ২৪
ঠিকানা: ১১৮ হাবিব ভবন ৪র্থ তলা, বিবিরপুকুর পশ্চিম পাড়, বরিশাল-৮২০০
মোবাইল: 01713956574, 01712445776 ইমেইল: [email protected]