চার বছর ধরে বন্ধ এতিমখানার কার্যক্রম। কিন্তু সরকারি বরাদ্দের টাকা তোলা হচ্ছে নিয়মিত। সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে একটি এতিমখানার কমিটির লোকজনের বিরুদ্ধে এই টাকা তুলে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার মাইজবাড়ি ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামে অবস্থিত এই এতিমখানার নাম ‘মোহাম্মদ আলী শিশুসদন’। এটির অবস্থান চকপাড়া দারুল উলুম হাফিজিয়া কওমি মাদ্রাসার কাছে।
শিশুসদনটিতে ভুয়া এতিম শিশু দেখিয়ে এবং ভুয়া বিল-ভাউচার দাখিল করে বরাদ্দের টাকা প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সমাজসেবা কার্যালয়ের কয়েকজন ব্যক্তি আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি নিয়ে তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি ওই এতিমখানায় গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির দরজায় তালা ঝোলানো। বারান্দায় খড় ও লাকড়ির গাদা। ঘরের জানালা দিয়ে ভেতরে দেখা গেল একটি বড় ব্যানার ঝোলানো। পরিত্যক্ত পড়ে আছে এতিমখানার ঘরটি। দেখে বোঝার উপায় নেই, এটি এতিমখানা। কোনো এতিম বা শিক্ষক কারও দেখা মেলেনি সেখানে।
স্থানীয়রা বলছেন, গত চার বছরে তাঁরা এখানে এতিমখানার কোনো কার্যক্রম চলতে দেখেননি। এতিম না থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ সম্পাদক নিজেই।
কাজীপুর উপজেলা সমাজসেবা অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বরাদ্দকৃত অর্থ উত্তোলন করেছে এতিমখানা কমিটি। তিন অর্থবছরে এতিমপ্রতি ২০০০ টাকা হিসাবে ২০ জন এতিমের জন্য বরাদ্দ হতো প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে মোট ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আবারও ভাড়াটে এতিম ও ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে প্রথম কিস্তির বরাদ্দের টাকা উত্তোলনের চেষ্টা করেন কমিটির লোকজন। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে বরাদ্দ স্থগিত করে উপজেলা সমাজসেবা অফিস।
নিয়ম রয়েছে, উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে বেসরকারি এতিমখানা কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত কমিটির স্বাক্ষরিত নিবাসী এতিমদের তালিকা ও ব্যয়ের বিল-ভাউচার দাখিল করবেন। সমাজসেবা কর্মকর্তা ওই এতিমখানার নিবাসী এতিম শিশুর সংখ্যা, কমিটির মেয়াদ যাচাই-বাছাই করে এতিম শিশুর খাওয়া, পোশাক ও চিকিৎসার ব্যয় বিল-ভাউচার অনুমোদন দেবেন। বেসরকারি এতিমখানায় অবস্থানরত এতিমের মোট সংখ্যার সর্বোচ্চ ৫০ ভাগ ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ডের জন্য বিবেচিত হবে। নিয়মিত এতিমখানা পরিদর্শন করে সেই এতিমদের জন্য বরাদ্দ চূড়ান্ত করা হবে। কিন্তু মোহাম্মদ আলী শিশুসদন এখন পর্যন্ত সমাজসেবা কর্মকর্তা পরিদর্শনই করেননি বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এতিমখানার পাশের বাসিন্দা মতলেব নামের এক বৃদ্ধ বলেন, ‘এই যে এহিন দিয়া যাওয়া-আসা হরি ৪-৫ বছর ধইরা কোনো এতিম দেহি না। এতিমখানা খোলাও দেহি না। কিন্তু টেহা তুইলা কারা কারা বলে খায়।’
আসাদুল ইসলাম নামের আরেক ব্যক্তি জানান, এখানে করোনার সময় থেকে কোনো এতিম নেই। তবে হালিম নামের এক শিক্ষক তাঁর মাদ্রাসার ছাত্র নিয়ে এসে ভিডিও করেন। সেই ভিডিও দেখিয়ে টাকা তোলা হয়।
বাদুল্লি নামের আরেকজন বৃদ্ধ বলেন, ‘আমার বাড়ি এই জাগাতই। এহিনেই আমরা সব সময় বইসা থাকি। এহিনে যে এতিম ছলপল খাওয়াদাওয়া করে, তা আমরা দেহি নাই। কয়েক বছর ধইরা এতিমখানায় তালা দেওয়া।’
এতিমখানাসংলগ্ন চকপাড়া দারুস সালাম কওমি মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ বলেন, ‘পাঁচ-ছয় বছর ধরে এতিমখানায় কোনো এতিম নেই। আমাদের মাদ্রাসার কয়েকটা ছাত্র ছিল, তাদের এতিম দেখিয়ে যখন টাকা তোলে এতিমখানার কমিটির লোক, তখন আমরা মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়েছি।’
এতিমখানা কমিটির সভাপতি জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘এই মাদ্রাসায় আমরা জমি দিছি। টাকা তুলছি। বাকি আছিল সব পরিশোধ করছি। এতিমখানার জন্য মেলা কেনাকাটা করছি।’ এতিমখানায় এতিম নেই, তবুও টাকা তুলেছেন কেন, জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘আমাকে সময় দেন এতিম নিয়ে আইসা দিমু।’
এতিমখানার সাধারণ সম্পাদক ও কুনকুনিয়া আল-ফালাহ নুরানিয়া হাফিজিয়া কওমি মাদ্রাসার মোহতামিম মাওলানা আব্দুল খালেক বলেন, ‘২০২১ সালের পরে আসলে এতিম নাই। এতিম ভর্তি আছে। আমাকে সময় দিলে সব হাজির করতে পারব।’ আপনার মাদ্রাসার ছাত্রকে এতিম দেখিয়ে বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করেছেন কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো উত্তরই দেননি। বলেন, ‘আমার কাছে সব কাগজপত্র আছে। ফয়সাল স্যার তদন্ত করতেছেন, তাঁর কাছে সব কাগজ জমা দিছি। তিনিই সব দেখবেন, আপনারা দেখার কেউ না।’
তদন্ত কমিটির প্রধান কাজীপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘বেশ কিছুদিন আগে আমাদের তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ব্যস্ততার কারণে তদন্ত শুরু করতে একটু দেরি হয়ে গেছে। আমরা এতিমখানায় গিয়েছিলাম, এতিম পাইনি। পরিত্যক্ত অবস্থায় এতিমখানাটি। আমরা সত্যটাই প্রতিবেদন আকারে জমা দেব।’
কাজীপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সোহেল রানা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা আসলে পরিদর্শন করতে পারিনি। সিরাজগঞ্জ থেকে এসে এখানে সপ্তাহে এক দিন অফিস করি। তদন্ত কমিটি তদন্ত করে যদি আমার সম্পৃক্ততা পায়, আমার শাস্তি হবে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে গতকাল মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে সিরাজগঞ্জের সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান খান বলেন, ‘বিষয়টি দেখতেছি।’ তবে সমাজসেবা কার্যালয়ের গাফিলতি বা অভিযুক্ত কমিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে তিনি সুনির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য করেননি।
ক্রাইম জোন ২৪
ঠিকানা: ১১৮ হাবিব ভবন ৪র্থ তলা, বিবিরপুকুর পশ্চিম পাড়, বরিশাল-৮২০০
মোবাইল: 01713956574, 01712445776 ইমেইল: [email protected]