পুরোনো বাত বা আর্থ্রাইটিসের ব্যথাসহ শারীরিক যেকোনো ব্যথা সারাতে ‘পরীক্ষিত সমাধান’ দাবি করে অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে ‘বুরাক অয়েল’ নামের একধরনের তেল। নিজস্ব ওয়েসবাইট, ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত এটিসহ নানা ব্যথা নিরাময়ের তেলের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। এ ধরনের পণ্যের উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত সব স্তরেই সরকারের ঔষধ প্রশাসনের অনুমোদন প্রয়োজন। তবে বুরাকসহ অনেক ব্যথার তেলের জন্যই তা নেই বলে জানা গেছে।
ওষুধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলে বাতের ব্যথা (আর্থ্রাইটিস), হাত-পা জ্বালাপোড়া, চুলকানি বা অ্যালার্জি দূর করার দাবি করলে তা ওষুধের মধ্যে পড়বে। এ ক্ষেত্রে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) অনুমোদন নিতে হবে। উপকরণ ও প্রস্তুত প্রণালির নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অনুমোদন নিতে হবে। উৎপাদিত তেল বা ওষুধ কতটুকু কার্যকর, তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কি না, তার পরীক্ষা লাগবে। অনুমোদিত হতে হবে মোড়কে লেখা তথ্যও।
বুরাক অয়েলের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পাতা ঘুরে দেখা যায়, সেখানে দাবি করা হচ্ছে এ তেল পরীক্ষিত প্রাকৃতিক সমাধান। ২২০ মিলিলিটারের একটি বোতল হাজার টাকার বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়, প্রায় ৫০ হাজার মানুষের অনেক ধরনের বাতের ব্যথা, কাঁধের ব্যথা, হাড়ক্ষয়ের ব্যথা, পুরোনো কোমর ব্যথা ভালো হয়েছে আল বুরাক তেলের মাধ্যমে। উৎপাদনকারীর দাবি, ৪৬টি প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে এ তেল তৈরি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জামালপুরের খাজা বশির আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী শফিকুল ইসলাম এক বছর ধরে এই তেল বাড়িতে প্রস্তুত করে সারা দেশে সরবরাহ করছেন। শফিকের বাড়ি জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার মেষেরচরে। অনলাইনে তেল বিক্রির জন্য নিজের বাড়িতে কলসেন্টার পর্যন্ত খুলেছেন তিনি। দিনে দুই থেকে তিন শ মানুষ তাঁর তেল অনলাইনে বা সরাসরি বাড়িতে গিয়ে সংগ্রহ করছেন।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন রয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে শফিকুল ইসলাম বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর আয়ুর্বেদিক ওষুধের লাইসেন্স দেওয়া এক বছর ধরে বন্ধ রেখেছে। শফিকুল দাবি করেন, তাঁর তেলের জন্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) নিবন্ধন রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর) এ তেল পরীক্ষাও করা হয়েছে।
বিএসটিআই সূত্রে জানা যায়, ওষুধজাতীয় কোনো কিছুর অনুমোদন বিএসটিআই দেয় না। ব্যথানাশক তেলের জন্য তাদের কোনো শ্রেণি নেই। বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) মো. সাইফুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, বুরাক অয়েল বা অন্য কোনো ওষুধজাতীয় অথবা ব্যথানাশক কোনো তেলের অনুমোদন বিএসটিআই দেয় না।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কোনো উপকরণের যদি থেরাপিউটিক ইন্ডিকেশন (নিরাময় বা প্রতিকারমূলক গুণ) আছে বা কোনো অসুখের প্রতিকারের জন্য ব্যবহার উপযোগী বলে দাবি করা হয়, তবে তা মেডিসিন (ওষুধ)। এর জন্য অবশ্যই ঔষধ প্রশাসন থেকে অনুমোদন নিতে হবে। তা অ্যালোপ্যাথিক, আয়ুর্বেদিক ও হারবাল যা-ই হোক না কেন।
মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, যেসব তেল ব্যথানাশক বলে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি করা হচ্ছে, তাতে মানুষের স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো অসুস্থতা সৃষ্টি হবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। এ থেকে ক্যানসারসহ ত্বকের বিভিন্ন রোগ হতে পারে।
বুরাক অয়েলের উৎপাদন ও বিপণনের বিষয়ে জামালপুরের ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক রনী চন্দ্র গোপ বলেন, ‘কয়েক সপ্তাহ আগে বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। তারা এটাকে আয়ুর্বেদিক ওষুধ বলেছে। ঔষধ প্রশাসনের নিবন্ধন দেখাতে পারেনি। আমি শিগগিরই সরেজমিনে গিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’
আইন অনুসারে, যেকোনো আয়ুর্বেদিক, ইউনানি, হারবাল বা প্রসাধনী উৎপাদন, বিক্রি বা বিপণনের আগে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন ও লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। বুরাক অয়েলের কোনো সরকারি নিবন্ধন নম্বর, গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্রোডাক্ট (জিএমপি) সনদও নেই।
গত এক সপ্তাহ ফেসবুক পর্যবেক্ষণ করে বুরাকসহ অন্তত এক শটি তেল, পাউডার, শ্যাম্পুর তথ্য পাওয়া যায়, যেগুলো ওষুধ দাবি করে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি পণ্যের ওয়েসবাইটে বা ফেসবুক পাতায় বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) পরীক্ষাগারের প্রতিবেদন দেখানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বুরাকের বিষয়ে বিসিএসআইআরের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে অ্যাকিউট ডারমাল ইরিটেশনের (ত্বকের তীব্র জ্বলুনি) কথা পাওয়া যায়। এই তেলগুলো ইঁদুরের মতো প্রাণীর শরীরে পরীক্ষা করা হয়েছে। বিসিএসআইআর মানুষের শরীরে পরীক্ষার বিষয়ে বলেনি।
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ তেলগুলো বিভিন্ন মেয়াদি জটিল চর্মরোগ এমন কি ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে। হরমোনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এসবের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা প্রমাণিত নয়।
চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. রোকন উদ্দিন বলেন, ‘যাঁরা এসব তেল ব্যবহার করছেন, তাঁদের মধ্যে অর্ধেক বা তার কমসংখ্যক মানুষের স্বল্প সময়ের জন্য ত্বকের ক্ষতি হবে। আর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির বিষয় তো রয়েছেই। যে কেউ ইচ্ছা করলেই কোনো কিছু তৈরি করে রোগমুক্তি বা নিরাময়ের কথা বলে বিক্রি করতে পারে না।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আসরাফ হোসেন বলেন, ‘ওষুধের কোনো উপাদান বলা হলে অবশ্যই ঔষধ প্রশাসনের অনুমোদন লাগবে। থেরাপিউটিক দাবি করলে ওষুধের আইনে পড়বে। উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের নিজেদের এবং উৎপাদনপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পণ্যটির মান, মোড়ক, অনলাইনের বিক্রি—সবকিছুর জন্য পরীক্ষা ও অনুমোদন প্রয়োজন।’
ক্রাইম জোন ২৪
ঠিকানা: ১১৮ হাবিব ভবন ৪র্থ তলা, বিবিরপুকুর পশ্চিম পাড়, বরিশাল-৮২০০
মোবাইল: 01713956574, 01712445776 ইমেইল: [email protected]