নতুন এক বৈপ্লবিক তত্ত্বের মাধ্যমে মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে প্রচলিত ‘বিগ ব্যাং’ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানালেন আন্তর্জাতিক একদল পদার্থবিদ। তাঁদের দাবি, ‘আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি বিগ ব্যাং থেকে নয়, বরং ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।
তাঁদের মতে, মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে একটি মহাকর্ষীয় সংকোচনের মাধ্যমে, যার ফলে একটি বিশাল ব্ল্যাকহোল তৈরি হয়। আর ওই ব্ল্যাকহোলের মধ্যে ওই ব্ল্যাক হোলের উপরিভাগে ঘটে একটি ‘বাউন্স’ বা প্রতিস্ফোরণ, যার ফলে আমাদের মহাবিশ্ব জন্ম নেয়।
নতুন এই গবেষণাপত্র সম্প্রতি ফিজিক্যাল রিভিউ ডি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এতে গবেষকেরা এমন একটি মডেল প্রস্তাব করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে মহাবিশ্ব শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়নি, বরং এটি একটি বৃহত্তর মূল মহাবিশ্বে সৃষ্ট একটি বিশাল ব্ল্যাকহোলের ভেতর থেকে উঠে এসেছে। এই তত্ত্বকে বলা হচ্ছে ‘ব্ল্যাকহোল ইউনিভার্স’।
ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথের ইনস্টিটিউট অব কসমোলজি অ্যান্ড গ্র্যাভিটেশনের অধ্যাপক এনরিকে গাজতানাগার বলেন, বিগ ব্যাং মডেল শুরু হয় একটি অসীম ঘনত্বের বিন্দু থেকে, যেখানে পদার্থবিদ্যার নিয়ম ভেঙে পড়ে। এটি একটি গভীর তাত্ত্বিক সমস্যা, যা নির্দেশ করে আমরা মহাবিশ্বের সূচনার বিষয়টি এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রচলিত প্রশ্নগুলোকে উল্টোভাবে দেখার চেষ্টা করেছি—বাইরের দিকে না তাকিয়ে ভেতরের দিকে। অর্থাৎ, একটি অতিরিক্ত ঘন পদার্থগুচ্ছ মহাকর্ষীয়ভাবে ধসে পড়লে কী হয়, তা নিয়ে চিন্তা করেছি।’
১৯৬৫ সালে রজার পেনরোজ দেখান, সাধারণ কিছু শর্তে মহাকর্ষীয় সংকোচন সব সময় একধরনের অসীম ঘন বিন্দুতে বা সিঙ্গুলারিটিতে পৌঁছায়। পরে স্টিফেন হকিংসহ আরও অনেক বিজ্ঞানী এই ধারণাকে আরও শক্ত ভিত্তি দেন। তাই অনেকেই মনে করেন, বিগ ব্যাংয়ের মতো সিঙ্গুলারিটি বা অসীম ঘন অবস্থা এড়ানো যায় না।
তবে এই ধারণাগুলো পুরোনো বা ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। কিন্তু যদি কোয়ান্টাম মেকানিকসের প্রভাব ধরা হয়, তাহলে পুরো গল্পটাই বদলে যেতে পারে।
গাজতানাগা বলেন, ‘আমরা দেখিয়েছি, মহাকর্ষীয় ধস একটি সিঙ্গুলারিটিতে শেষ হতে হবে না, বরং একটি পর্যায়ে পৌঁছে এটি আবার ফিরে আসতে পারে—অর্থাৎ ‘বাউন্স’ ঘটতে পারে। এই বাউন্সের ফলে একটি নতুন সম্প্রসারিত মহাবিশ্ব তৈরি হয়।’
অধ্যাপক গাজতানাগা বলেন, ‘আমরা দেখিয়েছি যে, মহাকর্ষীয় ধস এসে একটি সিঙ্গুলারিটিতে শেষ হতে হবে না। বরং, ধসে পড়া পদার্থের একটি মেঘ খুব ঘন হয়ে উঠতে পারে এবং তারপর ‘বাউন্স’ করে—অর্থাৎ আবার ছিটকে বেরিয়ে একটি নতুন সম্প্রসারিত পর্যায়ে প্রবেশ করতে পারে।
এই পুনর্জাগরণ (বাউন্স) পুরোপুরি সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম মেকানিকসের প্রাথমিক নিয়ম অনুযায়ী ঘটে। এমনকি এই বাউন্স নিজেই মহাবিশ্বের প্রাথমিক দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটায়, যা বিগ ব্যাং মডেলে ব্যাখ্যা করা হয়।
গাজতানাগার দাবি, ‘আমরা এখন একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধান পেয়েছি, যা দেখায় সঠিক পরিস্থিতিতে এই বাউন্স অপরিহার্য। এই মডেলের বড় শক্তি হচ্ছে, এটি পরীক্ষাযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। তার চেয়েও আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এই মডেল অনুসারে আমাদের মহাবিশ্ব সামান্য বাঁকানো। ঠিক যেমন পৃথিবীর পৃষ্ঠ।’
এই মডেল শুধু প্রচলিত মহাজাগতিক তত্ত্বের সমস্যাগুলোর সমাধান দেয় না, বরং আমাদের স্থান ও অস্তিত্ব সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। একই সঙ্গে, এটি মহাবিশ্বের প্রাথমিক ধাপে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের উৎপত্তি, ডার্ক ম্যাটারের প্রকৃতি ও গ্যালাক্সির বিকাশ সম্পর্কে নতুন আলোকপাত করতে পারে।
এই গবেষণা আরও কার্যকরভাবে যাচাই করার জন্য ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএ) আরাকিহস (ARRAKIHS) মহাকাশ মিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই মিশনে অধ্যাপক গাজতানাগা প্রধান বিজ্ঞান সমন্বয়কারী হিসেবে রয়েছেন।
আরাকিহস স্যাটেলাইটটি এমন অতি ক্ষীণ আলোকমাত্রার (আলট্রা লো সারফেস ব্রাইটনেস) গ্যালাক্সির প্রান্তীয় কাঠামো শনাক্ত করতে সক্ষম, যেগুলো গ্যালাক্সির গঠন ও ডার্ক ম্যাটারের সমবায় ইতিহাস সংরক্ষণ করে। এই আলোকচিহ্নগুলো বিগ ব্যাং মডেল থেকে ভিন্ন কোনো মহাজাগতিক সূচনার ইঙ্গিতও দিতে পারে।
এই স্যাটেলাইটে চারটি ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল টেলিস্কোপ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে দুটি নিও-ইনফ্রারেড, একটি অপটিক্যাল ও একটি নেয়ার-আল্ট্রাভায়োলেট তরঙ্গে একই আকাশ অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করে। ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথের ইনস্টিটিউট অব কসমোলজি অ্যান্ড গ্র্যাভিটেশন এই ফিল্টার সিস্টেমের প্রস্তাব ও নকশা করেছে।
এসব মহাকাশভিত্তিক সুবিধা পৃথিবী থেকে পর্যবেক্ষণ করে সম্ভব নয়। এর ফলে আমাদের নিজস্ব মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিসহ অন্যান্য গ্যালাক্সির গঠন ইতিহাস উন্মোচিত হতে পারে।
তথ্যসূত্র: ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথ
ক্রাইম জোন ২৪
ঠিকানা: ১১৮ হাবিব ভবন ৪র্থ তলা, বিবিরপুকুর পশ্চিম পাড়, বরিশাল-৮২০০
মোবাইল: 01713956574, 01712445776 ইমেইল: [email protected]