জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। চলতি বছর সংক্রমণ এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মৌসুমি নয়, বরং সারা বছর ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়ছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে ১৬ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, মারা গেছেন অন্তত ১৭ জন। ফিজি, সামোয়া ও টোঙ্গা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি শুরুর সতর্কবার্তা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক সিনড্রোমিক সারভেইলেন্স সিস্টেমের (পিএসএসএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ ও অঞ্চলগুলোতে ১৬ হাজার ৫০২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ সময়ে মারা গেছে ১৭ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, ২০১৬ সালের পর এ বছরই সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে ফিজি, সামোয়া ও টোঙ্গা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
প্যাসিফিক কমিউনিটির (এসপিসি) উপ-মহাপরিচালক ডা. পাউলা ভিভিলি জানান, আগে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ছিল মৌসুমি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংক্রমণের মৌসুম দীর্ঘ হচ্ছে আর কিছু এলাকায় এখন সারা বছর ডেঙ্গুর ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে।’
ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এর উপসর্গের মধ্যে রয়েছে—ব্যাপক জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, গিঁট ও মাংসপেশিতে ব্যথা, চামড়ায় ফুসকুড়ি এবং গুরুতর ক্ষেত্রে মৃত্যু। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অতিরিক্ত বৃষ্টি ও আর্দ্রতা মশার প্রজননের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করছে। এর ফলে যেখানে আগে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছিল না, সেখানেও ঝুঁকি বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সপোজারস, ডিজিজেস, জেনোমিকস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সেন্টারের পরিচালক ও মহামারীবিদ ডা. জোয়েল কফম্যান বলেন, ‘ডেঙ্গু এমন একটি রোগ, যার প্রকোপ সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের ফল বলে আমরা বলতে পারি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বৃষ্টিপাত পানির স্তর বাড়িয়ে দেয়, যা মশার ডিম ফোটায়—এটি তাদের প্রাকৃতিক প্রজনন প্রক্রিয়ার অংশ। ভারী বৃষ্টিতে স্থির পানির জায়গা বেড়ে যায়, যা মশার বংশবৃদ্ধির সুযোগ বাড়ায়।’
কফম্যান সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এই প্রাদুর্ভাব আরও বড় জনস্বাস্থ্য সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এটি এমন রোগগুলোর শুরু, যেগুলো পৃথিবীর উষ্ণতার সঙ্গে আরও সাধারণ ও মারাত্মক হয়ে উঠবে।’
এপ্রিল মাসে প্রাদুর্ভাব ঘোষণা করার পর সামোয়ায় এখন পর্যন্ত ছয়জন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছে, এর মধ্যে দুই ভাইবোনও রয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ৫ হাজার ৬০০ জনের বেশি। ফিজিতে এ বছর ডেঙ্গুতে আটজন মারা গেছে, আক্রান্ত ১০ হাজার ৯৬৯ জন। ফেব্রুয়ারিতে প্রাদুর্ভাব ঘোষণার পর থেকে টোঙ্গায় আক্রান্ত হয়েছে ৮০০ জনের বেশি এবং মারা গেছে তিন জন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রাদুর্ভাব দেখিয়ে দিচ্ছে জলবায়ু সংবেদনশীল রোগের প্রতি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভঙ্গুরতা কতটা বেশি, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে আরও তীব্র হবে।
আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেলের (আইপিসিসি) তথ্য অনুযায়ী, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ বিশ্বের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসারণের মাত্র ০.০৩ শতাংশের জন্য দায়ী। তবু তারাই জলবায়ুজনিত সবচেয়ে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে—বিশেষ করে মশাবাহিত রোগের ক্ষেত্রে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পালাউ, পাপুয়া নিউগিনি ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হয়েছে। অন্যদিকে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, পাপুয়া নিউগিনি, নাউরু ও ফিজির কিছু অংশে তীব্র খরা দেখা দিয়েছে। নিউজিল্যান্ডের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক রিসার্চ (এনআইডাব্লিউএ) জানিয়েছে, এই বৈপরীত্য অন্তত অক্টোবর পর্যন্ত চলবে।
কফম্যান বলেন, ‘যদিও বেশি বৃষ্টি মশার প্রজননের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে, চরম আবহাওয়াও মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ বাড়াতে পারে।’ এনআইডাব্লিউএ জানিয়েছে, বছরের প্রথমার্ধে প্রশান্ত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় অতি শুষ্ক বা প্রায় শুষ্ক অবস্থা দেখা গেছে। কফম্যান বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম শুষ্কতা মশাবাহিত রোগ কমাবে, কিন্তু বাস্তবে উল্টোটা ঘটেছে। বরং সংক্রমণের গতি বেড়েছে।’
ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের কারণে সামোয়া, কুক আইল্যান্ডস ও আমেরিকান সামোয়া জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। কুক আইল্যান্ডসে পুরো দ্বীপজুড়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান, নজরদারি জোরদার এবং লক্ষ্যভিত্তিক স্প্রে কার্যক্রম চালানো হয়েছে। টোঙ্গা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দ্বীপগুলোতে প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় ডব্লিউএইচও’র সঙ্গে কাজ করেছে। টুভ্যালু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও স্বাস্থ্য প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে। সামোয়া স্কুল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়েছে এবং জনস্বাস্থ্য প্রচারণা জোরদার করেছে।
নিউজিল্যান্ড সামোয়ায় একটি চিকিৎসক দল পাঠিয়েছে এবং ৩ লাখ নিউজিল্যান্ড ডলার (১ লাখ ৭৮ হাজার মার্কিন ডলার) মূল্যের চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় ও সহায়তা অব্যাহত রেখেছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপ্রতুল নজরদারি ব্যবস্থার কারণে এসব পদক্ষেপ কার্যকারিতা হারাচ্ছে। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের রোগ-পরিবেশবিদ ডা. ববি রেইনার বলেন, ‘বর্তমান রোগ নজরদারি ব্যবস্থা সচরাচর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট নয়। এর প্রমাণ হচ্ছে এ অঞ্চলে ডেঙ্গুর ক্রমবর্ধমান প্রকোপ, যা বৈশ্বিকভাবেও সত্য।’
মশা নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলোর মধ্যে রয়েছে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস, লার্ভিসাইড প্রয়োগ বা কীটনাশক ছিটানো। এ ছাড়া জীববৈজ্ঞানিক নিয়ন্ত্রণ, ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং কমিউনিটি পর্যায়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানও এর মধ্যে পড়ে। কিন্তু রেইনারের মতে, এসব পদ্ধতির অনেকগুলো কখনো কার্যকর প্রমাণিত হয়নি।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
ক্রাইম জোন ২৪
ঠিকানা: ১১৮ হাবিব ভবন ৪র্থ তলা, বিবিরপুকুর পশ্চিম পাড়, বরিশাল-৮২০০
মোবাইল: 01713956574, 01712445776 ইমেইল: [email protected]