জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের হত্যা, গুম, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় এক হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে এ পর্যন্ত সাবেক আইজিসহ পুলিশের ৬৩ জন সদস্য গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। মামলার অন্য আসামি পুলিশ সদস্যরা রয়েছেন গ্রেপ্তার-আতঙ্কে। এ ছাড়া গত এক বছরে অভিযোগ থাকা অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতি, ওএসডি ও বদলিসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, অনেকে মামলার আসামি হলেও যেসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে, শুধু তাঁদেরকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।
পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার দেড় দশকের স্বৈরশাসনামলে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ পর্যায়ে চব্বিশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান কঠোরভাবে দমনের সময় পুলিশের গুলিসহ বিভিন্নভাবে শত শত মানুষ নিহত হন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হলে বিক্ষুব্ধ জনতার ক্ষোভের শিকার হয় শত শত থানা। কর্মস্থল ছেড়ে পালিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। সরকার বারবার হুঁশিয়ারিমূলক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাঁদের ধীরে ধীরে কাজে ফিরিয়ে আনে।
সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে ৮৪৪ জন নিহত হওয়ার হিসাব দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এসব হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক
মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য, বিচারপতি ও আমলার পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদেরকেও আসামি করা হয়েছে। তাঁদের অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনায় সারা দেশে ৭৬১টি মামলা করা হয়েছে। মামলায় পুলিশের ১,১৬৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে পুলিশের সাবেক ও বর্তমান বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সাবেক আইজিপি ৭, অতিরিক্ত আইজিপি ৪১, সাবেক ডিআইজি ১২ ও ১১ জন বর্তমান ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ৪৯, পুলিশ সুপার (এসপি) ৬৬, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ৬৫, সহকারী পুলিশ সুপার ৩৫, পরিদর্শক ১৮৭, উপপরিদর্শক (এসআই) ৩৪০, এএসআই ১১৭ ও কনস্টেবল ২২৪ জন। বাকিরা টিএসআই, এটিএসআই, নায়েক ও পদ উল্লেখ না থাকা পুলিশ সদস্য।
মামলার তথ্য অনুযায়ী, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি, ১৭৫টি মামলা করা হয়েছে। এরপর সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে ১৫৯, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের বিরুদ্ধে ১২৯, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১১৮, ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের সাবেক উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইনের বিরুদ্ধে ২৭, সাবেক আইজিপি শহীদুল হকের বিরুদ্ধে ২৪ এবং বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা করা হয়েছে।
অভ্যুত্থানের সময় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করার অভিযোগে পুলিশের সাবেক ৬২ জন সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার মো. জসীম উদ্দীন মোল্লা, পুলিশ সুপার তানভীর সালেহীন, এস এম তানভীর আরাফাত, আবদুল্লাহিল কাফীসহ ১৮ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাঁদের বিচারপ্রক্রিয়া চলছে। অন্যান্য মামলার তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও অন্য ইউনিটগুলো।
বিভিন্ন মামলার আসামি মোট পুলিশ সদস্যের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৬৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, এ কে এম শহীদুল হক, ডিএমপির সাবেক কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া, যুগ্ম কমিশনার মশিউর রহমান, ডিআইজি মোল্লা নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলাম, সিএমপির সাবেক কমিশনার অতিরিক্ত আইজি ইকবাল বাহার রয়েছেন।
আসামিদের মধ্যে পলাতক রয়েছেন আলোচিত সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মো. মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, মেহেদী হাসানসহ অনেকে। তাঁদের অনেকে দেশত্যাগ করেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘মাঠে দায়িত্ব পালন করা পুলিশ সদস্যরা আদেশ পালন করেছেন। এতেই এখন তাঁরা হত্যা মামলার আসামি। মামলার আসামি অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের ভাগ্যে কী আছে, জানা নেই।’
তবে মামলার আসামি হলেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। গত ২৮ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) বাহারুল আলম বলেন, ‘৫ আগস্টের পর একটি মহল হয়রানির উদ্দেশ্যে মূল আসামির সঙ্গে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে মামলার আসামি করেছে। কিন্তু তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে দায়ভার পাওয়া যাবে, শুধু তার জন্যই আমরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেব।’
হত্যা ছাড়াও ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার, মারধর, গুলি চালানো, লুটপাট, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং মিথ্যা মামলা করার অভিযোগ। অভিযোগ থাকা এসব পুলিশ সদস্যের মধ্যে গত এক বছরে জনস্বার্থে অবসর দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত আইজিপিসহ ৬৪ জনকে। এই ৬৪ জনের মধ্যে রয়েছেন সুপারনিউমারারি পদোন্নতিপ্রাপ্তসহ অতিরিক্ত আইজিপি ১৮, ডিআইজি ১৫, অতিরিক্ত ডিআইজি ১, পুলিশ সুপার ২, সহকারী পুলিশ সুপার ১৯ ও পরিদর্শক ৯ জন। এ ছাড়া আন্দোলনের সময় ‘বিতর্কিত ভূমিকা রাখায়’ শতাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) করা হয়েছে। বদলি করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা প্রায় সব কর্মকর্তাকে।
গত ২৩ জুলাই ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের সাবেক উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইনকে সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার। আন্দোলনের পরপরই তাঁর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সরকার পরিবর্তনের পর হত্যা মামলার আসামি ডিসি ইকবাল কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী বিষয়টিকে পলায়নের শামিল উল্লেখ করে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
সবশেষ গত ১০ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের সময় ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা নয় পুলিশ পরিদর্শককে (নিরস্ত্র) অবসর দিয়েছে সরকার।
অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক থেকে শুরু করে পরিদর্শক পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদবঞ্চিত অনেকে পদোন্নতিও পেয়েছেন।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে পুলিশ সদস্যদের অনেকে নিহতও হয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে সংঘর্ষ, হামলা, অগ্নিসংযোগসহ নানাভাবে পুলিশের ৪৪ সদস্য নিহত হন।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যেসব পুলিশ সদস্য হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি, তাঁদের মধ্যে সুস্পস্ট প্রমাণ পাওয়া ব্যক্তিদেরই কেবল গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।’
শাহাদাত হোসাইন আরও বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট যে পরিস্থিতি ছিল, সেখান থেকে পুলিশ বাহিনী তাদের মনোবল বাড়ানোর পাশাপাশি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।
ক্রাইম জোন ২৪
ঠিকানা: ১১৮ হাবিব ভবন ৪র্থ তলা, বিবিরপুকুর পশ্চিম পাড়, বরিশাল-৮২০০
মোবাইল: 01713956574, 01712445776 ইমেইল: [email protected]