বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুলে শাহরিয়ার খান আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ। আজ সোমবার (১১ আগস্ট) বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
এর আগে সূচনা বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তাঁর বক্তব্য শেষে গুলি করার ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয় ট্রাইব্যুনালে।
সাক্ষ্য দেওয়ার শুরুতে আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ আদালতের উদ্দেশে বলেন—ঘাতকদের বসানো হয়েছে কেন? এ সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটা কোর্টের সিস্টেম। এটা আন্তর্জাতিক আদালত। কোনো আসামি তথ্য-প্রমাণে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা নির্দোষ হিসেবে ধরে নিই। তাই সে বিষয়ে না বলে আপনি ন্যায়বিচারে সহযোগিতা করেন। যা বলতে এসেছেন, তা বলেন।’
পরে শাহরিয়ার খান পলাশ বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্ট আমি, আমার স্ত্রী, আমার দুই সন্তান, সাফওয়ান (৫) ও সুফিয়ান (২) গেন্ডারিয়ার ভাড়া বাসায় অবস্থান করছিলাম। আমার স্ত্রী আনাসকে ঘরে দেখতে না পেয়ে তার পড়ার টেবিলে যায় এবং সেখানে তার হাতের লেখা একটি চিঠি পায়। চিঠিটা আনাস তার কোচিং ক্লাসের রসায়ন খাতায় রেখে যায়। চিঠিটা একটি ওষুধ কোম্পানির প্যাডে লিখা ছিল। চিঠিটা তার মায়ের উদ্দেশে লিখে যায়। সেখানে লিখা ছিল, ‘‘মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। যদি না ফিরি, তাহলে গর্বিত হইয়ো।’’ চিঠিতে আরও কথা লেখা ছিল।’
তিনি বলেন, ‘দুপুরে আনাসের মায়ের মোবাইলে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে এবং জিজ্ঞাসা করা হয় ‘‘আপনাদের কেউ কি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়েছে?’’ তখন আমার স্ত্রী বলে, ‘‘আমার ছেলে আনাস গিয়েছে।’’ ওই লোকটি তখন আমার স্ত্রীকে দ্রুত মিটফোর্ড হাসপাতালে যেতে বলেন। আমার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘‘আমার মোবাইল নম্বর আপনি কীভাবে পেয়েছেন?’’ ওই লোকটি বলেন, ‘‘আপনার ছেলের সঙ্গে থাকা সীমবিহীন মোবাইল থেকে।’’ পরে জানতে পারি, ওই লোকটিও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একজন ছাত্র। তার নাম সৌরভ আহম্মেদ।’
শাহরিয়ার খান পলাশ বলেন, ‘সংবাদ শুনে আমি, আমার স্ত্রী ও আমার শ্বশুর মিটফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগের সামনে একটি স্ট্রেচারের ওপর রক্তাক্ত অবস্থায় আমার সন্তানের গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পাই। সেখানে উপস্থিত আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন ছাত্র-জনতার মাধ্যমে জানতে পারি, চানখাঁরপুল মোড়ে নিমতলী নবাব কাটারা গলিতে আমার ছেলে আনাসকে পুলিশ গুলি করে। তারপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে জরুরি বিভাগে ভর্তির টিকিট, আনাসের ব্যবহৃত উক্ত মোবাইল এবং মৃত্যুসনদ নিয়ে আমরা আনাসকে কোলে করে রিকশায় করে বাসায় নিয়ে আসি। বাসায় নিয়ে আসার পরে আনাসের লাশ নিয়ে এলাকার লোকজন স্বৈরাচার খুনি হাসিনার বিরুদ্ধে মিছিল করে।’
আনাসের বাবা বলেন, ‘ওই দিন আসরের নামাজের পর গেন্ডারিয়া ধুপখোলা মাঠে আনাসের জানাজার জন্য নিয়ে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ (১৪ বছর) নামের আরও একজন ছাত্রের লাশ জানাজার জন্য আনা হয়। সেও ওই দিনই চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। দুজনের জানাজা একই সঙ্গে হয়। আমরা আনাসকে গোসল করাইনি। শহীদি মর্যাদায় অর্থাৎ গোসল না করিয়ে রক্তাক্ত পরিধেয় পোশাকসহ দাফন করি।’
শাহরিয়ার খান পলাশ বলেন, ‘চানখারপুলের ওই ঘটনায় আমার ছেলে আনাসসহ ছয়জন নিহত হয়। পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, এডিসি আক্তার, এসি ইমরুল, ওসি (অপারেশনস শাহবাগ) আরশাদের পারস্পরিক নির্দেশে ও নেতৃত্বে কনস্টেবল সুজন, কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমন, কনস্টেবল নাসিরুল ইসলামদের গুলিতে উক্ত ছয়জন শহীদ হয় মর্মে বিভিন্ন গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মাধ্যমে জানতে পারি। আমি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা আমার ছেলে আনাসসহ অন্যদের নিহত ও আহত করেছে, তাদের বিচার ও ফাঁসি চাই।’
উল্লেখ্য, আজ এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। প্রথম সাক্ষী হিসেবে শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের বাবা সাক্ষ্য দেন।
ক্রাইম জোন ২৪
ঠিকানা: ১১৮ হাবিব ভবন ৪র্থ তলা, বিবিরপুকুর পশ্চিম পাড়, বরিশাল-৮২০০
মোবাইল: 01713956574, 01712445776 ইমেইল: [email protected]