শিরোনাম

এক রিয়াজ নিহত তিন এলাকায়

এক রিয়াজ নিহত তিন এলাকায়

ভোলার নির্মাণশ্রমিক মো. রিয়াজ (৩৫)। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিতে নিহত হন তিনি। অথচ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের তিনটি এলাকাকে তাঁর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল দেখিয়ে তিনটি আলাদা হত্যা মামলা হয়েছে। তিন মামলায় আসামির সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ৩৪টি জেলার রাজনীতিক, প্রবাসী, ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও পুলিশ সদস্য।

নিহত শ্রমিকের দরিদ্র পরিবারকে সাহায্য করার কথা বলে তাদের কাছ থেকে সব আসল কাগজপত্র নিয়ে এসব মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

রিয়াজের স্ত্রী ফারজানা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, গত বছরের আন্দোলনের শেষ দিন, ৫ আগস্ট সকালে তাঁর স্বামী যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা এলাকার বাসা থেকে বের হন। বেলা ১১টার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার গেটের সামনে গুলি খেয়ে পড়ে ছিলেন রিয়াজ। কয়েক ঘণ্টা পর তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে তাঁর লাশ ভোলায় নিয়ে দাফন করা হয়।

ভোলায় রিয়াজের পরিবার যখন শোকে বিমূঢ়, তখন এ হত্যা নিয়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে দুটি এলাকায় মামলা হয়। প্রথম মামলা হয় ২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায়। রিয়াজের স্ত্রী ফারজানা বেগম সেজে একজন এ মামলা করেন। এতে রিয়াজের স্ত্রীর আসল জন্মনিবন্ধন, নিকাহনামা, এনআইডিসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত কাগজপত্র ব্যবহার করা হয়। মামলায় রিয়াজের মৃত্যুর স্থান দেখানো হয় নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের সামনে। আসামি করা হয় শামীম ওসমানসহ ১৯২ জনকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফারজানা বেগম এ মামলা করেননি। তিনি এর খবর জানতেনও না। ফতুল্লা থানার পুলিশ ও আসামিরা তাঁকে মামলার কথা জানিয়েছেন।

ফারজানা বেগম বর্তমানে দুই মেয়েকে নিয়ে ডেমরার মাতুয়াইলে বাবা মো. ফরিদের সঙ্গে এক বাসায় থাকেন। সম্প্রতি সেখানে ফারজানা আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রথম মামলার আসামিরা তাঁকে খুঁজে বের করেন। তিনি তিন আসামিকে নারায়ণগঞ্জ আদালতে গিয়ে জামিন করান। কারণ, নিরপরাধ কেউ তাঁর মৃত স্বামীর জন্য ভুগুক, এটা তিনি চাননি। আদালতে গিয়ে ফারজানা বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর অনেকেই সহায়তার কথা বলে তাঁর কাগজপত্র নিয়েছিলেন। তাঁদেরই কেউ হয়তো মামলাটি করেছেন।

ফতুল্লা থানার মামলায় ফারজানার কাগজপত্র ব্যবহার করলেও অন্য ব্যক্তির একটি মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়। আজকের পত্রিকা তথ্যপ্রযুক্তি ও পুলিশের সহায়তায় জানতে পেরেছে মোবাইল নম্বরটি জনৈক সাইফুল ইসলামের এনআইডি দিয়ে নিবন্ধিত। সাইফুলের গ্রামের বাড়ি বরিশালে, থাকেন নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায়। আজকের পত্রিকাকে সাইফুল বলেন, এজাহারে তাঁর মোবাইল নম্বরটি কে দিয়েছেন, তিনি তা জানেন না। তিনি কোনো মামলা করেননি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শুভঙ্কর বিশ্বাস বলেন, ‘ঘটনাটি ভুয়া বলে নিশ্চিত হওয়ার পর মামলার তদন্ত আর এগোয়নি। আসামিরা জামিনে আছেন, আমরা হয়তো চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেব।’

রিয়াজের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চলতি বছরের মার্চে ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি নালিশি মামলা করেন জাহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। এই মামলায় রিয়াজকে হত্যার ঘটনাস্থল দেখানো হয় ভাটারা থানার যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের সড়ক এলাকা। এ মামলায় রিয়াজের সব আসল কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। বাদী জাহিদুল দাবি করেছেন, তিনি নিহত রিয়াজের ভাই। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রিয়াজের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। মামলায় ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাসহ ২৮১ জনকে আসামি করা হয়। আদালত মামলাটি ভাটারা থানা-পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেন। এ মামলায় ৩৪ জেলার শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রবাসী, ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও পুলিশ কর্মকর্তা। দক্ষিণ কোরিয়াপ্রবাসী ইসমাইল হোসেন এই মামলার ২১৮ নম্বর আসামি। তিনি একমাত্র গ্রেপ্তার হওয়া আসামি।

প্রবাসী ইসমাইল হোসেন আগেই সম্ভাব্য মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই পেতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইজিপির কাছে আবেদন করেছিলেন। গত ২ ফেব্রুয়ারি তিনি রমনা থানায় জিডিও করেন। এ ছাড়া ডিএমপি কমিশনারের কাছে গত ১৯ মে একটি অভিযোগ দেন ইসমাইলের বড় ভাই খোরশেদ আলম বাবুল। তিনি অভিযোগ করেন, ফরচুন টাওয়ারের ফ্ল্যাট মালিকদের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে দুলাল নামে এক ব্যক্তি বিভিন্ন মামলায় তাঁর ভাইয়ের নাম ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। এর সঙ্গে জড়িত দালাল হাতকাটা বাহার ও সাদ্দাম।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে ফরচুন টাওয়ারে গিয়ে দুলালকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে কল করলে তাঁর স্ত্রী রোকসানা আক্তার পলি ধরে বলেন, দুলালের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ বানোয়াট।

রিয়াজের ভাই দাবি করে মামলা করা জাহিদুল ইসলাম নিজের ঠিকানা দিয়েছেন ভাটারা নতুন বাজারের ৯৯১ নম্বর। অনুসন্ধানে জানা যায়, এটি কোনো বাড়ির ঠিকানা নয়, বরং জমির দাগ নম্বর। হাজি আক্কাস আলী নামে এক পুরোনো বাসিন্দাসহ এলাকার কয়েকজন জানান, নতুন বাজারে এমন নম্বরে কোনো নির্দিষ্ট বাড়ি নেই।

জানা গেছে, জাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অন্তত সাতটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আলোচিত পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রতারণা ও চেক জালিয়াতির মামলা। সিআইডির তদন্তে জানা যায়, দুর্নীতি মামলার আসামি পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলীর সহযোগী ছিলেন জাহিদুল।

ভাটারা থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আনোয়ার হোসেন বাদী জাহিদুলকে খুঁজে পাননি। আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, রিয়াজ ভাটারায় নিহত হননি এবং ৫ আগস্ট সেখানে যানওনি। এসআই আনোয়ার বলেন, ‘জাহিদের ঠিকানা মিথ্যা। তাঁকে এখনো খুঁজছি।’

জাহিদের আইনজীবী এম কাওসার আহমেদ বলেন, তিনি নিজেও বাদীকে খুঁজে পাচ্ছেন না।

তবে গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় খোঁজ নিয়ে জাহিদের বিষয়ে তথ্য মিলেছে। মামলার নথিতে তাঁর স্থায়ী ঠিকানা ভোলা জেলার শম্ভুপুর ইউনিয়ন। ঠিকানামতো চর কোরালমারা গ্রামে গিয়ে জানা যায়, তিনি এলাকায় ‘জুয়েল’ নামে পরিচিত। স্থানীয় ইউপি মেম্বার মঞ্জু হাওলাদার বলেন, ‘পুলিশ তাঁকে প্রায়ই খুঁজতে আসে। কিন্তু সে বাড়িতে থাকে না।’

স্বামী হত্যার ঘটনায় রিয়াজের স্ত্রী ফারজানা নিজে ঢাকার আদালতে একটি মামলা করেছেন। অভিযোগটি এখনো থানায় নথিভুক্ত হয়নি। আদালত যাত্রাবাড়ী থানাকে ঘটনা যাচাই করে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মাসুম বিল্লাহ বলেন, মামলার ২১৩ জন আসামির অবস্থান যাচাই শেষে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

ফারজানা বেগম দুঃখ করে বলেন, ভুয়া ব্যক্তিরা মামলা করায় তাঁর আসল মামলাই এখন তদন্তাধীন।

এ বিষয়ে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, একটি ফৌজদারি ঘটনায় একাধিক মামলা হতে পারে না। ভুয়া মামলা দ্রুত বাতিল করে প্রকৃত মামলাটিরই তদন্ত হওয়া উচিত।



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button