কিছুটা সংস্কার আর নাম পরিবর্তন করেই বছর পার


অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হওয়ার পরই পর্যায়ক্রমে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর বিদ্যমান কমিটি ভেঙে দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। সম্প্রতি তিনটি সংস্থাকে একীভূত করার আগে দেশে ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সংখ্যা ছিল ৫৫টি। ক্রিকেট ও ফুটবল বাদে বাকি ফেডারেশনগুলো থাকে ক্রীড়া পরিষদের অধীনে। গত এক বছরে ক্রীড়াঙ্গনে কতটুকু বদল আনতে পেরেছে অন্তর্বর্তী সরকার?
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হওয়ার পর আজকের পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের চিত্র বদলে দিতে সিস্টেমের সংস্কার করা দরকার। সিস্টেম মানে গঠনতন্ত্রে হাত দেওয়া। কিন্তু গঠনতন্ত্র সংস্কারে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারে প্রথমে গঠন করা হয় সার্চ কমিটি। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ব্যাডমিন্টনের সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন জোবায়দুর রহমান রানা। সব ফেডারেশনে নতুন অ্যাডহক কমিটির সুপারিশ করেছেন তাঁরা। কিন্তু এখন পর্যন্ত মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কমিটি ঘোষণা করেনি ক্রীড়া পরিষদ। সার্চ কমিটি ও তাদের মধ্যে দেখা যায় মতবিরোধও। বিশেষ করে আর্চারি ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটি নিয়ে। যেখানে সার্চ কমিটি তানভীর আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সুপারিশ করে। কিন্তু ক্রীড়া পরিষদ আগের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজীব উদ্দিন চপলকেই সেই দায়িত্বে রাখে। পরে বিতর্কের মুখে তানভীরকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
ধাপে ধাপে অ্যাডহক কমিটি গঠন হওয়ায় ফেডারেশনগুলো সেভাবে সচল হতে পারেনি। খেলাধুলায়ও আসেনি তেমন গতি। অথচ সামনেই রয়েছে এশিয়ান যুব গেমস, ইসলামিক সলিডারিটি গেমস ও সাউথ এশিয়ান গেমস। শুটিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফেডারেশনের কমিটি দেওয়া হয় অনেক দেরিতে। অবশ্য সেই কমিটি ঘোষণার পর সাবেক শুটার ও বর্তমান কোচ শারমিন আক্তার রত্নার পদত্যাগ জন্ম দেয় বিস্ময়ের। ধারণা করা হয়, বিতর্কিত এক সংগঠককে কমিটিতে জায়গা করে দেওয়ার কারণেই পদত্যাগ করেন তিনি।
তিন সপ্তাহ আগে দায়িত্ব পাওয়া শুটিং ফেডারেশনের কমিটি এখনো কোনো খেলা আয়োজন করতে পারেনি। এমনই দৃশ্য দেখা যায় অনেক ফেডারেশনেই। হকিতে যেমন লিগ হচ্ছে না। এ মাসেই মাঠে খেলা গড়ানোর প্রত্যাশা ফেডারেশনের। অল্প সময়ে ব্যর্থতার মুখও দেখেছে তারা। ৪৩ বছর পর এই প্রথম এশিয়া কাপ হকিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে অনূর্ধ্ব-২১ দল আগামী নভেম্বরে ভারতের তামিলনাড়ুতে খেলবে জুনিয়র হকি বিশ্বকাপে।
ফেডারেশনের মতো ক্রীড়া স্থাপনায়ও বদল এনেছে সরকার। পরিবর্তন করা হয়েছে ১৯৫টি ক্রীড়া সংস্থার নাম। ম্যারাথন সংস্কারের পর পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছে জাতীয় স্টেডিয়াম। কিন্তু ঘাসের মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। ঢাকার বাইরে বেশ কিছু স্টেডিয়ামের সুযোগ-সুবিধার মান রয়েছে সেই আগের মতোই। পায়নি আধুনিকতার ছোঁয়া। দেশের আট বিভাগে আটটি স্পোর্টস হাব গড়ার কথা বরাবরই বলে আসছেন ক্রীড়া উপদেষ্টা। তা নির্মাণে সহায়তা করতে প্রস্তুত সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, অন্তর্বর্তী সরকার চলে যাওয়ার পর স্পোর্টস হাব গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কতটুকু?
ক্রীড়াঙ্গন সচল রাখতে ফেডারেশনগুলোতে দরকার নির্বাচিত কমিটি। নির্বাচন আয়োজন প্রসঙ্গে কয়েক সপ্তাহ আগে সংবাদমাধ্যমে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব আমিনুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘যুগোপযোগী আদর্শ গঠনতন্ত্র প্রণয়নের পর সেগুলো ফেডারেশনের কাছে দেওয়া হবে। তারা নিজেদের মতো কাস্টমাইজ করে নেবে। এরপরই প্রত্যেককে নির্বাচন করতে বলা হবে।’
সাংগঠনিক সংস্কারের জন্য একটি আলাদা কমিটি গঠন করা হয় গত ২৪ জুন। গঠনতন্ত্র সংস্কার করা তাদেরই দায়িত্ব। ৩০ কার্যদিবসের ভেতর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল তাদের। এ প্রসঙ্গে কমিটির আহ্বায়ক ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সেলিম ফকিরের কাছে জানতে চাওয়া হয় গতকাল। কিন্তু ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
ফিফার নিয়ম অনুসারে, বাফুফেতে সরকারের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। তবে পরিবর্তনের ছোঁয়াটা যেন অনিবার্যই ছিল। ১৬ বছর বাফুফে সভাপতির চেয়ার থাকার পর নির্বাচন না করার ঘোষণা দেন কাজী সালাউদ্দীন। তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে সেই চেয়ারে বসেন তাবিথ আউয়াল। নতুন কমিটি দায়িত্ব হাতে নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে নারী ফুটবল দল দ্বিতীয়বারের মতো জেতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। কিন্তু বাফুফের পক্ষ থেকেই ঘোষিত বোনাসের অর্থ (দেড় কোটি টাকা) এখনো পাননি ফুটবলাররা।
সেই সাফল্য কিছুটা আড়াল করে দিয়েছিল পুরুষ দলকে। ঘুমন্ত সেই পরিস্থিতি এক ধাক্কায় জাগ্রত হয় হামজা চৌধুরীর আগমনে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই ফুটবলার ডিসেম্বরে অনুমতি পান বাংলাদেশের হয়ে খেলার। তাঁকে কেন্দ্র করে বাফুফে সাজায় ফুটবলের জোয়ার ফিরিয়ে আনার ছক। বাংলাদেশি ফুটবলার হিসেবে হামজাকে স্বাগত জানানো হয় রাজকীয়ভাবে। এক হামজার ছোঁয়ায় বেড়ে যায় প্রবাসী ফুটবলারদের নিয়ে উন্মাদনা। তাঁর দেখাদেখি আসতে থাকেন শমিত শোম-ফাহামিদুল ইসলামরা। এমনকি বয়সভিত্তিক পর্যায়েও দেখা যায় প্রবাসীদের আনাগোনা। শুধু ফুটবল কেন, হামজাকে দেখে টনক নড়ে সরকারেরও। অন্যান্য ফেডারেশনগুলোয় নির্দেশ দেওয়া প্রবাসী খেলোয়াড় খোঁজার। যে কারণে জাতীয় বক্সিংয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী জিনাত ফেরদৌসকে নিয়ে ছিল এত আগ্রহ।
দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েদের ফুটবল। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ নারী দল জায়গা করে নিয়েছে এশিয়ান কাপে। বয়সভিত্তিক পর্যায়েও এসেছে সাফল্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেয়েদের লিগ আয়োজন করতে পারেনি বাফুফে। জেলা পর্যায়ে ফুটবল এখনো মাঠে গড়ায়নি। ভবিষ্যৎ ফুটবলার তুলে আনার মঞ্চ পাইনিওয়ার লিগ ২০২২ সালের পর রয়েছে হিমাগারে।