[ad_1]
ভোর ৫টা। ভেসে আসে কাঠ কাটার ঠকঠক শব্দ। ধীরে ধীরে খুলতে থাকে ঘরের দরজা। একে একে ৩০টি ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে ঘুম থেকে জেগে ওঠা মানুষ। গোসল, ধোয়া-মোছা আর সকালের কাজগুলো সেরে সবাই একসঙ্গে হাজির হয় কমিউনাল রান্নাঘরে, সকালবেলার নাশতার জন্য।
এভাবেই সকাল শুরু হয় ভিয়েতনামের তাই হাই নামের গ্রামের বাসিন্দাদের। গ্রামটিতে বসবাস করে ২০০ মানুষ। তারা একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে যেমন দিন শুরু করে, তেমনি একসঙ্গে খেয়ে রাতে ঘুমাতে যায়। এটি কোনো সিনেমা কিংবা উপন্যাসের গল্প নয়, আর তাই হাই গ্রামটিও কোনো কল্পিত গ্রাম নয়।
তাই হাই গ্রামের বাসিন্দারা ২২ বছর ধরে একসঙ্গে তিন বেলা খাওয়াদাওয়া করে। নাশতা খাওয়ার পর সবাই নিজ নিজ কাজে চলে যায়। অনেকে চা-বাগানে কাজ করে। চা-পাতা তুলে সেগুলো শুকিয়ে ও ভেজে চা বানায়। কেউ করে কাঠের কাজ। আবার অনেকে ভ্রমণ গাইডের কাজও করে। ভিয়েতনাম এখন আন্তর্জাতিক ভ্রমণপ্রেমীদের আকর্ষণীয় ভ্রমণ গন্তব্য। গ্রামের কেউ মধু সংগ্রহ করে, কেউ চাষবাস, কেউ আবার গরু-মুরগির খামারে ব্যস্ত সময় পার করে। গ্রামের পাঁচ বছরের নিচের শিশুরা থাকে নার্সারিতে, আর বড়রা নিজে বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে স্কুলে যায়।
এই গ্রামে দুপুরের খাবারের জন্য একই রকম ঘণ্টা বাজে, যেমন বাজে সকাল বা সন্ধ্যায়। ঘড়িতে যখন বেলা ১১টা, কাঠ কাটার শব্দ ভেসে আসে মধ্যাহ্নভোজের ডাক হিসেবে। আগে সবাই একসঙ্গে একই সময় একই প্লেটে কয়েকজন মিলে দুপুরের খাবার খেত, অপেক্ষা করত সবাই আসা পর্যন্ত। এখন সময় বদলেছে বলে একটা নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া শেষ করতে হয়। একই প্লেটে কয়েকজন করে না খেয়ে এখন আলাদা প্লেটে খাবার খাওয়া হয়। তবু অনেক পরিবার এখনো পুরোনো নিয়ম মেনে চলে। এখনো সবাই একসঙ্গে না খেলে খাওয়াই শেষ হয় না যেন!
দুপুরের পরের খাওয়ার ঘণ্টাটি বাজে সন্ধ্যা সাতটায়। দিনের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে সবাই রাতের খাবার খেয়ে নিজ নিজ ঘরে ফিরে যায়। তারপর পরিবারের সঙ্গে সময় কাটায়।
গ্রামটির বাসিন্দাদের দাবি, তারা অন্য গ্রামগুলো থেকে আলাদা। কারণ, সবাই একই হাঁড়ির খাবার খায়, একই খরচে চলে। যে যার মতো কাজের দক্ষতা অনুযায়ী কাজ করে। এ গ্রামের সব আয় জমা হয় গ্রামপ্রধান আর একটি কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে থাকা তহবিলে। সেখান থেকে চলে গ্রামবাসীর খাওয়া-দাওয়া, বিদ্যুৎ, যন্ত্রপাতি, ঘরের মেরামত, পড়াশোনা, চিকিৎসা, এমনকি বিয়ের খরচও। সেখানে কেউ কারও সম্পত্তি বা আয় নিয়ে তুলনা করে না। কে কত পেল বা দিল, তা সেখানে গুরুত্ব পায় না। মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ কিনতে চাইলে কাউন্সিলের অনুমতি লাগে।
ভিয়েতনামের তাই হাই গ্রামে এমন ব্যতিক্রমী জীবনযাত্রার সূচনা করেছিলেন ৬৩ বছর বয়সী নগুয়েন থি থান হাই। তিনি ছিলেন তাই জাতিগোষ্ঠীর নারী। তিনি দেখেছিলেন, তরুণ প্রজন্ম ধীরে ধীরে ছেড়ে দিচ্ছে তাদের ঐতিহ্যবাহী কাঠের বাড়ি আর সংস্কৃতি। তাই জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষায় নিজের সব জমিজমা বন্ধক রেখে তিনি কিনে ফেলেন ৩০টি প্রাচীন উঁচু কাঠের ঘর। ২০০৩ সালে তিনি সেগুলো স্থাপন করেন থাই গুয়েন শহরের বাইরে ২০ হেক্টর জায়গায়। সেখানে গড়ে তোলেন ঐতিহ্য রক্ষায় নিবেদিত এক ছোট্ট গ্রাম। প্রথমে শুধু তাঁর পরিবার ও তাই সংস্কৃতি ভালোবাসেন, এমন কয়েকজন সেখানে থাকতেন। তারপর ধীরে ধীরে তৈরি হলো একটি গ্রাম। সবাই মিলে বানিয়েছেন জলপ্রবাহ, বিদ্যুৎ এনেছেন, ইট বানিয়েছেন, রাস্তা পাকা করেছেন, বনভূমি সৃজন করেছেন। এই সম্মিলিত জীবনে বেশি উপকার পেয়েছে গ্রামের নারীরা। এই গ্রামে থাকা নারীদের রান্না নিয়ে চিন্তা নেই। গ্রামেই স্কুল বলে শিশুদের দূরের স্কুলেও যেতে হয় না। কারও বিয়ের সময় পুরো গ্রাম এসে সাহায্য করে। তাদের কাজ হলো বিক্রি আর পর্যটকদের দেখভাল। বাকিরা নিজ নিজ দায়িত্বটুকু ভাগ করে নেয়।
২০১৪ সালে থাই গুয়েন প্রদেশ সরকার এই গ্রামকে আনুষ্ঠানিক পর্যটনকেন্দ্র ঘোষণা করে। শুরুতে মানুষ সেখানে যেত গ্রাম্য পরিবেশ আর ঐতিহ্যবাহী খাবার খাওয়ার টানে। খবর ছড়িয়ে পড়লে সেখানে পর্যটনের গতি বাড়ে। ২০২২ সালে জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা তাই হাই-কে বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্যটন গ্রামের মর্যাদা দেয়। এই স্বীকৃতিতে গ্রামের পা এখনো মাটিতে। এখনো অনেকে পর্যটন ছাড়াও করে চলেছেন ভেষজ ওষুধ তৈরি, দেশি মদ বানানো, আর প্রথাগত মিষ্টি তৈরির কাজ। শতবর্ষ পুরোনো কাঠের বাড়িগুলো আজও মানুষের বাসস্থান আর অতিথিদের থাকার জায়গাও বটে।
এখানে শিশুরা তাই লোকসংগীত গায়, দেশীয় খেলনা দিয়ে খেলাধুলা করে। তাই ভাষায় কথা বলে। এখনকার তরুণেরাও বিশ্বাস করেন, ‘এক হাঁড়ি, এক পয়সা’ এই দর্শনেই রয়েছে সত্যিকারের শান্তি। গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে এখানে আরও অনেক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ আসেন। সকলের আকর্ষণ, সুখের খোঁজে একসঙ্গে থাকা, ঐতিহ্যের মধ্যে বাঁচা।
সূত্র: ভিএন এক্সপ্রেস
[ad_2]
ঠিকানা: ১১৮ হাবিব ভবন ৪র্থ তলা, বিবিরপুকুর পশ্চিম পাড়, বরিশাল-৮২০০
মোবাইল: 01713956574, 01712445776 ইমেইল: [email protected]