[ad_1]
ইলিশ কি সব সময় মাছের রাজা ছিল? প্রশ্নটি এখন করলে অনেকে বাঁকা চোখে তাকাবেন আমার দিকে। কিন্তু সত্যি কথা হলো, ইলিশের এখন যে রাজা রাজা ব্যাপার, সেটা একসময় ছিল না। কী ছিল তাহলে? এখানেই অনেক মজা লুকিয়ে রয়েছে।
যাঁরা মঙ্গলকাব্যগুলোর কিছু পড়েছেন, এই ধরুন ‘মনসামঙ্গল’, তাঁরা জানেন, সেখানে অনেক মাছের নাম উল্লেখ থাকলেও ইলিশ নিতান্তই সাধারণ মাছ হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে। বরং সেখানে রোহিত মৎস্য বা রুই মাছ, মৃগেল, মদগুর বা মাগুর মাছ, চিতল, বোয়াল মাছের কথা ইলিশের চেয়ে ঢের বেশি উল্লিখিত হয়েছে। আবার কখনো কখনো পাবদা বা কাতল মাছেরও প্রশস্তি আছে; কিন্তু ইলিশ প্রায় অধরা। বিজয় গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণ’-এ বেহুলার বিয়ের অনুষ্ঠানে ইলিশ মাছ ভাজার কথা বলা হয়েছে। আর কিছু নেই। তবে বলে রাখা ভালো, বিজয় গুপ্ত সেই পনেরো-ষোলো শতকের কবি। বাঙালি কবি। তাঁর বাড়ি বরিশালে।
এই বাঙালি কবিও যখন ইলিশের প্রশস্তি রচনা করেননি, তখন বোঝা যায়, ইলিশ ছিল সে সময় নিতান্তই সাধারণ মাছ। সেই সাধারণ মাছ এখন অসাধারণ; দাম কিন্তু নাগালের বাইরে। সেই দুঃখে এক শোকগাথা লিখেও ফেলা যায়। হয়তো লিখতে হবে একসময়।
ইলিশ নিয়ে আমাদের স্মৃতির কোনো অন্ত নেই। আমরা যারা আশি-নব্বইয়ে কৈশোর কাটিয়েছি, তাদের স্মৃতিতেও ইলিশ এক আশ্চর্যের বস্তু বটে। ব্যক্তিগতভাবে মধ্য আশিতে আমি উত্তরবঙ্গে আমাদের হাটে ইলিশ মাছ স্তূপ করে রাখতে দেখেছি। সেগুলো বিক্রি হতো ৫০ টাকা জোড়ায়। একটু বেলার দিকে এক হালি ইলিশ পাওয়া যেত ৮০ টাকায়। আর সেসব ইলিশ ভাজার ঘ্রাণ নিজেদের রান্নাঘর ছাড়িয়ে পাড়া বেড়াতে যেত দুপুরবেলা। সেই ঘ্রাণে কত পেতনি যে বাড়ির আশপাশের উঁচু গাছে সন্ধ্যায় সমবেত হতো! সেই গল্প লিখতে গেলে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তারানাথ তান্ত্রিকের দ্বিতীয় পর্ব লিখতে হবে। তা আর সম্ভব নয় বলে একটা আফসোস রয়েছে। জীবনের কী নির্মম পরিহাস, এখন ইলিশ মহার্ঘ হয়ে যাওয়ায় আফসোস করতে হয়। সেই আফসোস অবশ্য এখন অনেকে লিখে প্রকাশ করেন।
সে যাক। কখনো জীবনে ইলিশ আসবে, কখনো সে অধরা থেকে যাবে। জীবন এমনই। আজ এই দুঃখের দিনে একটি গল্প বরং লিখে রাখি। এটি সেই ‘সোনালি দিনের’ গল্প। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল, যিনি ছিলেন খাদ্যবিষয়ক সংকলন ‘নুনেতে ভাতেতে’র সহসম্পাদক, তিনি সেই গল্প শুনিয়েছিলেন আমাকে। সেটি ছিল, মাঝিদের ইলিশ খাওয়ার গল্প কিংবা বলা যেতে পারে মাঝিদের ইলিশ রেসিপি।
গল্পটা এমন, একদিন তিনি কৌতূহলবশত কোনো এক ইলিশ ধরার নৌকায় সওয়ার হয়েছিলেন গঙ্গা নদীর কোনো অংশে। প্রমাণ সাইজের বেশ কিছু ইলিশ ধরা পড়েছে জালে। দুপুর হয়েছে। নৌকার অপরিসর জায়গায় অস্থায়ী রান্নাঘর। সেখানে তোলা উনুনে ফুটছে মোটা চালের ভাত। পাশেই ইলিশ মাছ কাটা-ধোয়া চলছে। একপর্যায়ে ইলিশের টুকরাগুলো লবণ-হলুদ মাখিয়ে রাখা হলো রোদে। ভাত হয়ে গেছে। থালায় রাখা হলো লবণ-হলুদ মাখানো ইলিশের টুকরা। তার ওপর দেওয়া হলো উনুন থেকে নামানো মাড়সহ গরম ভাত। কয়েক মিনিট অপেক্ষার পর ভাতের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল ইলিশের তেল। মাঝিরা সেই তেলে ভাত মেখে খাওয়া শুরু করলেন।
কলকাতার ফ্ল্যাটে বসে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল আমাকে বলেছিলেন, ‘বহুদিন এমন ইলিশ খাই না রে!’ ওরে ইলিশ ভাই, আর কতকাল মানুষের দুঃখের কারণ হবে?
[ad_2]
ঠিকানা: ১১৮ হাবিব ভবন ৪র্থ তলা, বিবিরপুকুর পশ্চিম পাড়, বরিশাল-৮২০০
মোবাইল: 01713956574, 01712445776 ইমেইল: [email protected]