আমাদের একজন লিটন বাশার ছিলেন


মজিবর রহমান নাহিদ : কিছু মানুষ চলে যাওয়ার পরও রয়ে যান—মনের গভীরে, স্মৃতির প্রতিটি পরতে। তারা আর ফিরে আসেন না, কিন্তু তাদের অনুপস্থিতিই প্রতিদিন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, তারা ছিলেন। তাদের হাসি, কথাবার্তা, নির্ভরতা আর ভালোবাসা—সবকিছু মিলিয়ে তারা হয়ে ওঠেন এক অপূরণীয় শূন্যতার নাম।
লিটন বাশার ভাই ছিলেন তেমনই একজন মানুষ। যিনি শুধু সাংবাদিক ছিলেন না—ছিলেন আমাদের অভিভাবক, আশ্রয়, সাহস আর নির্ভরতার প্রতীক। যিনি শুধু কথা বলতেন না, সাহস দিয়ে চলার পথ দেখাতেন।
২০১৭ সালের ২৭ জুন, হঠাৎ এক সহকর্মীর ফোনে জানতে পারলাম—শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক নেতা, শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক বরিশাল অফিস প্রধান লিটন বাশার ভাই ইন্তেকাল করেছেন।
খবরটা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম—এমন মানুষ কি হঠাৎ করে চলে যেতে পারেন? তবু নিশ্চিত হতে ফোন দিলাম একে একে অনেক সিনিয়র সহকর্মীকে। তারাও একই দুঃসংবাদ জানালেন।
আমি ছুটে গেলাম শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গিয়ে জানতে পারলাম, লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভাইয়ের বাসায়—গোড়া চাঁদ দাস রোডে।
সেখানে গিয়ে দেখলাম, প্রিয় ভাইয়ের নিথর দেহটি বাসার সামনে রাখা। একে একে সব গণমাধ্যমকর্মী উপস্থিত হচ্ছেন। শুধু সহকর্মীই নয়—প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতারাও ছুটে এসেছেন শেষবারের মতো প্রিয় মানুষটিকে দেখতে। কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে চারপাশের বাতাস।
বিশেষ করে বেলায়েত বাবলু ভাইয়ের কান্না কেউই থামাতে পারছিল না। কে থামাবে? সবাই তো চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল। ভাইয়ের ছোট্ট শিশুসন্তান তখনও বুঝে উঠতে পারেনি—তার বাবা আর নেই।
কিছুক্ষণ পরে মরদেহটি পাশের একটি ভবনের নিচে নিয়ে যাওয়া হয় গোসল করানোর জন্য। গোসল শেষে লিটন ভাইকে নিয়ে যাওয়া হয় তার প্রিয় জায়গায়—বরিশাল প্রেসক্লাবে।
সেখানে ক্লাবের নিচতলায় তাকে শ্রদ্ধা জানান বরিশালের সবস্তরের সাংবাদিকরা। কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। আজও সেই দৃশ্য চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে।
এরপর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নগরীর অশ্বিনী কুমার টাউন হলে, প্রথম জানাজার জন্য। জানাজা শেষে লাশবাহী ট্রাকে করে আমরা রওনা দিই তার গ্রামের বাড়ি চরমোনাইয়ের উদ্দেশ্যে। তখনও সহকর্মীদের চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল।
চরমোনাইয়ে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় লিটন ভাইকে। আমাদের একজন সত্যিকারের অভিভাবক চিরবিদায় নিলেন সেদিন।
লিটন বাশার ভাই ছিলেন বরিশালের সাংবাদিক সমাজের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, এক মহানায়ক।
তার কাছ থেকে শিখেছিলাম, কিভাবে ছোটদের স্নেহ করতে হয়। শিখেছিলাম, কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে দাঁড়াতে হয়।
২০১৭ সালের শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের নির্বাচনে তার সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। মাত্র এক ভোটে তিনি পরাজিত হলেও, তার প্যানেলের ১৭ জন সদস্যই বিজয়ী হয়েছিলেন। সেই বিজয়ের প্রকৃত রূপকার ছিলেন তিনিই।
এরপর আমাদের বরিশাল তরুণ সাংবাদিক ফোরামের নির্বাচন হয়। আমি তখন সভাপতি প্রার্থী। শুরু থেকেই লিটন ভাই আমাকে সাহস দিতেন। বলতেন, “ন্যায় ও নীতি নিয়ে চললে জীবনে কেউ আটকাতে পারবে না।”
আল্লাহর রহমতে, আমি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মারুফ হোসেনসহ আমাদের পুরো প্যানেল জয়লাভ করি। বিজয়ের পর আমরা ফুল নিয়ে ভাইয়ের কাছে যাই। ভাই তখন খুব খুশি হয়েছিলেন।
আমাদের অভিষেক অনুষ্ঠানে তাকে প্রধান অতিথি করা হয়েছিল। সেদিন তিনি যা বলেছিলেন, তার প্রতিটি কথা আজও আমার সাংবাদিকতার পথে আলোর দিশা দেখায়।
ভাই প্রায়ই বলতেন—
“ব্যাটা, সাহসের সঙ্গে সব কাজ করবি, দেখবি এগিয়ে যাবি ইনশাআল্লাহ।”
আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে যখন পেছনে ফিরে তাকাই, তখন মনে হয়—তার সঙ্গে খুব বেশি সময় কাটাতে পারিনি, কিন্তু অল্প কিছু দিনের স্মৃতিগুলোই আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়—
আমাদের একজন লিটন বাশার ছিলেন।
আজ এই প্রিয় মানুষটির মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি।
মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা—তিনি যেন ভাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন। আমিন।