শিরোনাম
নারী

এক কন্যার হাতে সবুজ বিপ্লব

এক কন্যার হাতে সবুজ বিপ্লব

মাজুলি, আসাম। এখন এর পরিচিতি বিশ্বের বৃহত্তম নদীদ্বীপ হিসেবে। তবে সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই দ্বীপ এখন ভয়ংকর এক বাস্তবতার মুখোমুখি। বন্যা, ভাঙন আর ভূমিক্ষয়ের দুঃখ যেন এখানে প্রত্যেক মানুষকে গ্রাস করছে। সেই বাস্তবতার মাঝে নতুন আশার আলো নিয়ে এগিয়ে এসেছেন ২৫ বছরের এক তরুণী—মুনমুনি পায়েং।

মুনমুনির নাম এখন শুধু আসামে নয়, যেন পুরো ভারতের অনুপ্রেরণার প্রতীক। তাঁকে অনেকে ডাকেন ‘ফরেস্ট কুইন অব আসাম’ নামে। তাঁর স্বপ্ন একটাই—মাজুলি দ্বীপকে ১০ লাখ দেশীয় গাছ দিয়ে আবার সবুজে ভরিয়ে তোলা।

উত্তরাধিকারের গল্প

মুনমুনির পরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরেক কিংবদন্তি নাম—যাদব মোলাই পায়েং। বিশ্ব তাঁকে চেনে ভারতের ‘অরণ্যমানব’ হিসেবে। একাই তিনি

১ হাজার ৩৬০ একর জঙ্গল গড়ে তুলেছিলেন। সেটি আজও পৃথিবীর কাছে এক বিস্ময়ের গল্প। তাঁরই মেয়ে মুনমুনি। বৃক্ষরোপণ, পরিচর্যা—এসব বিষয়ে বাবার সঙ্গে তাঁর রয়ে গেছে শৈশবের স্মৃতি।

তবে মুনমুনির লড়াই কেবল উত্তরাধিকারের গল্প নয়, তিনি মনে করেন, গাছ লাগানো শুধু ঐতিহ্য ধরে রাখার কাজ নয়; এটি দায়িত্ব আর ভবিষ্যতের প্রতি অঙ্গীকার। তাই তিনি গড়ে তুলেছেন নিজের সংগঠন ‘সেউজ ধরণি’ বা সবুজ ধরিত্রী। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি শিশু, নারী এবং স্থানীয় লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেছেন সবুজ আন্দোলন।

এক লাখে এক প্রজন্ম

প্রকল্পটি শুধু বৃক্ষরোপণের নয়, এর ভেতরে রয়েছে সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন। মুনমুনি চান, মাজুলির প্রত্যেক নারী হোক সবুজ যোদ্ধা, শিশুরা হয়ে উঠুক মিনি ফরেস্টার। তাদের হাতে যখন গাছের চারা রোপিত হয়, তখন কেবল মাটিই শক্ত হয় না, মানুষের মনও দৃঢ় হয়।

রোপণের জন্য মুনমুনি বেছে নিয়েছেন আম, কাঁঠাল, জাম, বকুল, শিমুল ইত্যাদি দেশীয় প্রজাতির গাছ। এসব গাছ শুধু পরিবেশ রক্ষা করে না; বরং খাদ্য, আশ্রয় ও কর্মসংস্থানও তৈরি করে। ফলে বৃক্ষরোপণ এখানে একসঙ্গে পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতির সমাধান হয়ে দাঁড়ায়।

চ্যালেঞ্জ আর সংগ্রাম

মাজুলি দ্বীপ প্রতিবছর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভাঙন আর ভূমিক্ষয় গ্রাম থেকে গ্রাম মুছে দেয়। এই বাস্তবতায় গাছ লাগানো একদিকে যেমন কঠিন কাজ, তেমনি জীবন বাঁচানোরও একমাত্র উপায়। মুনমুনি বলেন, ‘গাছ আমার ভাইবোনের মতো। তাদের বাঁচানো মানে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ বাঁচানো।’

আর্থিক সংকট, সমাজের কিছু অংশের অনাগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ—সবই তাঁর লড়াইয়ের সঙ্গী। তবু তিনি থেমে থাকেননি। ধীরে ধীরে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, প্রকৃতি রক্ষা মানে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা।

স্বীকৃতি ও সম্মান

মুনমুনির কাজ এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রশংসিত। ২০২২ সালে স্যাংচুয়ারি নেচার ফাউন্ডেশন তাঁকে ইয়াং ন্যাচারালিস্ট অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সংবাদমাধ্যম—সবখানেই তাঁর গল্প।

ভবিষ্যতের ডাক

আজ মাজুলির মাটিতে যখন একটি শিশু গাছ লাগায়, কিংবা কোনো নারী গ্রামের আঙিনা সবুজে ভরিয়ে তোলেন; সেই দৃশ্যে প্রতিফলিত হয় মুনমুনির স্বপ্ন। এক মেয়ের হাতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন এখন যেন এক প্রজন্মের আন্দোলন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মুনমুনি পায়েংয়ের গল্প আমাদের শেখায়, পরিবেশ রক্ষা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি প্রত্যেক মানুষের কাজ। তিনি প্রমাণ করেছেন, একটি চারা লাগানো মানে শুধু গাছ রোপণ নয়, এটি একটি ভবিষ্যৎ রোপণ।



ক্রাইম জোন ২৪

আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button