শিরোনাম
পাকিস্তান শাহিনসের কাছে পাত্তা পেল না বাংলাদেশ ‘এ’ইটনা স্টেডিয়ামে খেলা বন্ধ করায় ইউএনওর বাসায় হামলা, ৯ পুলিশ-আনসার সদস্য আহতভোররাতে হাঁসের মাংস খেতে ৩০০ ফিটে যান আসিফ মাহমুদ, না পেয়ে যান ওয়েস্টিনেনেত্রকোনায় বিএডিসি ভবনের ছাদ ধসে ৩ শ্রমিকের মৃত্যুকর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় বরখাস্ত এএসপি আরিফুজ্জামানবাপাউবোর মহাপরিচালকের সঙ্গে বোর্ড কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতবিনিময়চট্টগ্রাম থেকে পাইপলাইনে তেল আসবে ঢাকায়, শনিবার উদ্বোধনদুদক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত আইন দুই মাসের মধ্যে কার্যকর হবে: আসিফ নজরুলউন্নত মানসিকতা গঠনে ইসলামের দিকনির্দেশনাহঠাৎ কিসের ক্ষোভ ঝাড়লেন হৃদয়

জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পরের বাংলাদেশকে যেভাবে মূল্যায়ন করছে আটলান্টিক কাউন্সিল

জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পরের বাংলাদেশকে যেভাবে মূল্যায়ন করছে আটলান্টিক কাউন্সিল

গণঅভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর এক বছর পেরিয়ে গেছে। তবুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এখনো জীবন্ত জুলাই বিপ্লবের চেতনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি থেকে শুরু করে সরকার পতনে ভূমিকা রাখা সেই সব শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষদর্শী বয়ান শোনা এবং ক্যাম্পাসে হাঁটলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, এই এক বছরে দেশ আসলে কী কী নিয়ে লড়ছে। সবচেয়ে বড় কথা, এ সবকিছু মনে করিয়ে দেয় সেসব নেতাদের দৃঢ় অবস্থান, যারা এই গণঅভ্যুত্থান পরিচালনা করেছিলেন, যাতে করে ফ্যাসিবাদী শাসন আর কোনোভাবেই ফিরতে না পারে।

হাসিনার বিদায়ের এক বছর পূর্তিতে গত ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা করেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কত দিন হবে, সেই অনিশ্চয়তার বড় অংশই কেটে গেছে। একই দিনে ড. ইউনূস ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ উত্থাপন করেন, যেখানে জুলাই বিপ্লবের মূল নীতিগুলো সংরক্ষিত হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলো ‘জুলাই সনদ’ নিয়েও ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এই সনদে তারা সংস্কারের প্রতি যৌথ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে, যাতে আরেকটি স্বৈরাচারী সরকারের উত্থান রোধ করা যায়। সব মিলিয়ে, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় ঐকমত্য—দুটো বিষয় মিলিয়েই দেশে নির্বাচনী রাজনীতি ফেরার পথ সুগম হয়েছে।

এক বছর পূর্তিতে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্‌যাপনের মতো অনেক কিছু আছে। হাসিনার বিদায়ের পর যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে তারা রাষ্ট্রের মৌলিক কার্যক্রম পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। এটা মোটেও সহজ কাজ ছিল না, কারণ আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের ক্ষমতাকালে সরকারি প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যাপকভাবে রাজনীতিকরণ করা হয়েছিল। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক দল দ্রুত ও দৃঢ়ভাবে পদক্ষেপ নেয় হাসিনা ঘনিষ্ঠদের লুটপাটের শিকার ব্যাংকিং ব্যবস্থার সম্ভাব্য ধস ঠেকাতে। এই সাফল্যের কৃতিত্বের অংশীদার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সহযোগীরাও—বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। এসব প্রতিষ্ঠান দেশের টালমাটাল আর্থিক ব্যবস্থা স্থিতিশীল করতে ঘনিষ্ঠভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করেছে।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে ও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতির জন্য এক বিস্তৃত আন্তর্জাতিক জোট গঠন করেছে। ওই সময়ে বাংলাদেশ তার ঐতিহ্যগত মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের চেষ্টা চালায়, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও ছিল, শেখ হাসিনার আমলে যা বেশ খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছিল।

ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কয়েক মাসের যোগাযোগের পর, গত ৩১ জুলাই অন্তর্বর্তী সরকার ওয়াশিংটনের সঙ্গে এক নতুন বাণিজ্য কাঠামো চুক্তি করে। এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা বাংলাদেশের পণ্যের ওপর প্রতিযোগিতামূলক ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হবে। একই সময়ে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। চলতি বছরের মার্চে ড. ইউনূসের সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের বৈঠক হয়। তবে ভারতের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক এখনো শীতল। যদিও গত এপ্রিলে ড. ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শেখ হাসিনার আমলে সংঘটিত অপরাধের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং ভুক্তভোগীদের অন্তত কিছুটা হলেও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এই অপরাধ শুধু ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে আন্দোলনকারীদের ওপর চালানো ভয়াবহ নির্যাতনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর মধ্যে রয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের আগের সময়ে সংঘটিত বহু বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম এবং অন্যান্য নির্যাতনও। ন্যায়বিচারের পথে এক বড় বাধা অনেক অভিযুক্ত ব্যক্তির দেশত্যাগ। এই লোকগুলো সরকার পতনের সময়কার বিশৃঙ্খলার মধ্যে পালিয়ে যায়। শেখ হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের অনেককে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। সেখানে তাঁরা সব ধরনের অভিযোগ সত্ত্বেও অবাধে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারছেন।

হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিলেও ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে তাঁর সরকারের কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁর এবং অন্য যাঁরা ওই সময় দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করেছে। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকায় হাসিনার সাবেক সরকারি বাসভবনে জাদুঘর স্থাপন করে তাঁর শাসনামলের নির্যাতনের ঘটনাগুলো স্মৃতিচারণ করেছে। হাসিনা সরকারের অনেক ভুক্তভোগী এখনো আর্থিক ও মানসিক সংকটে ভুগছেন, আর এসব সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় সম্পদও সীমিত। এরই মধ্যে একটি ‘ট্রুথ অ্যান্ড হিলিং কমিশন’ (সত্য ও পুনর্মিলন কমিশন) গঠনের প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই কমিশন হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত অপরাধগুলো নথিবদ্ধ করবে এবং ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারের সহায়তার জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে।

বর্তমানে ভুক্তভোগী বা অপরাধীদের পক্ষ থেকে পুনর্মিলনের কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। হাসিনার নেতৃত্বাধীন সাবেক ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম আইসিটিতে চলমান বিচার প্রক্রিয়ার রায় না আসা পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে এবং দলটি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না বলেই মনে হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এখনো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের আটক অবস্থার বিষয়ে উদ্বেগ জানাচ্ছে। এদের অনেকে এমন অভিযোগে মামলার মুখোমুখি, যার পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই বলে মনে করা হয়। এই আটক ব্যক্তিদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের দায়িত্ব সম্ভবত আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা সরকারের ওপরই পড়বে, যা জবাবদিহি, বিচার ও পুনর্মিলনের সামগ্রিক নীতির অংশ হবে।

বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রাপ্য গুরুত্ব পায় না। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে খুব কমসংখ্যক বিশেষজ্ঞই বাংলাদেশ নিয়ে গভীরভাবে নজর রাখেন। ফলে, যারা দেশ সম্পর্কে ভুল তথ্য বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে চায়, তাদের জন্য জনমত প্রভাবিত করা সহজ হয়ে যায়। গত এক বছরে এটাই ঘটেছে। দেশ ও দেশের বাইরে এই ন্যারেটিভ ছড়ানো হয়েছে যে, হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানো হয়েছে, ইসলামপন্থী জঙ্গিবাদকে উসকে দেওয়া হয়েছে এবং দেশটিকে চীনের হাতে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এসবের কোনোটি-ই সঠিক নয়। নতুন নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এই সময়ে সত্যটি তুলে ধরা জরুরি।

হাসিনার পনেরো বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ ক্রমেই বিশ্ব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। বিদেশি সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের ভিসা দেওয়া হয়নি; বাক্‌স্বাধীনতার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এখন দেশটি আবারও বিশ্বের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে। তাই অর্থনীতি পুনর্গঠন, হাসিনা সরকারের অপরাধের বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং গণতান্ত্রিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর কাছ থেকে আরও মনোযোগ পাওয়ার সময় এসেছে।

লেখক

ওসমান সিদ্দিক আটলান্টিক কাউন্সিলের সাউথ এশিয়া সেন্টারের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো। তিনি ১৯৯৯-২০০১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ফিজি প্রজাতন্ত্রে দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে তিনি টোঙ্গা রাজত্ব, নাউরু প্রজাতন্ত্র ও টুভালু সরকারের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বেও ছিলেন।

জন ড্যানিলোভিচ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ফরেন সার্ভিস কর্মকর্তা। দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁর দীর্ঘ কর্মঅভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে ডেপুটি চিফ অব মিশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা রাইট টু ফ্রিডমের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।


ক্রাইম জোন ২৪

আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button