শিরোনাম

নিরপেক্ষ পুলিশের খোঁজে হিমশিম

নিরপেক্ষ পুলিশের খোঁজে হিমশিম

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব দিতে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কর্মকর্তা বাছাই নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ প্রশাসন। আগের তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে এই জটিলতা তৈরি হয়েছে। ফলে নির্বাচনী প্রশিক্ষণের জন্য বাছাই শেষে পুলিশ সদস্যদের একটি তালিকা করা হলেও কর্মকর্তাদের সংখ্যা পূরণ হয়নি।

পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলছে, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের সংখ্যায় যে ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণে আগের নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করলেও বিতর্কিত না হওয়া কর্মকর্তাদের আবার নেওয়া হতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) একই কথা বলেছে। এই নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশের প্রস্তুতিও বড় চ্যালেঞ্জ।

নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করতে পুলিশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি নির্বাচনকালীন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ঠিক রাখতে হবে। কিন্তু গত বছরের আগস্টের ঘটনায় হারানো মনোবল পুলিশ এখনো ফিরে পায়নি। বিগত তিনটি নির্বাচনে পুলিশ কর্মকর্তাদের একাংশের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে ভাবমূর্তির সংকটও রয়েছে। ফলে আগামী নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করা পুলিশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। পুলিশ সদস্যদের নির্বাচনী প্রশিক্ষণ শুরু হবে আগামী মাসে (সেপ্টেম্বর)।

জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, গত তিনটি সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারীদের যতটা সম্ভব এবার দায়িত্ব না দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। বিষয়টি কঠিন, তবে বাস্তবায়নের চেষ্টা থাকবে। তিনি জানান, সেপ্টেম্বরে পুলিশের নির্বাচনী প্রশিক্ষণ শুরু হবে। তালিকা প্রস্তুত হয়েছে। কর্মকর্তাদের এই প্রশিক্ষণে নির্বাচনী আইন, বিধিবিধান ও প্রায়োগিক বিষয় শেখানো হবে। গত ১৫ বছরে পুলিশ সদস্যরা সুষ্ঠু নির্বাচন দেখেননি, তাই এবার তাঁদের সেই প্রস্তুতি দেওয়া হবে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের আসন্ন নির্বাচনে দায়িত্বে না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ওই তিন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদেরও এবার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না। বিতর্কিত ওই তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী সব পুলিশ সদস্য, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের তালিকা করা হচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলছে, বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর মোট জনবল ১ লাখ ৯৩ হাজার ৪৮৭ জন। নির্বাচনের জন্য দায়িত্ব দিতে হবে দেড় লাখ সদস্যকে। বিগত তিন নির্বাচনে মাঠপর্যায়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশ সুপার (এসপি) ও উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার অভিযোগ আছে। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে তাঁদের বাদ রেখে তালিকা করা হয়েছে। তবে এতে প্রয়োজনীয় কর্মকর্তার সংখ্যা পূরণ হচ্ছে না।

পুলিশের সূত্র জানায়, নির্বাচনে মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব দিতে এরই মধ্যে পুলিশ সদস্যদের স্থায়ী ঠিকানা, রাজনৈতিক পরিচয় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদায়নের তথ্য সংগ্রহ করে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এই তালিকা সরকার আলাদা কয়েকটি সংস্থার মাধ্যমে যাচাই-বাছাইও করেছে। যাচাইয়ের ভিত্তিতে বাছাই করা সদস্যদের নির্বাচনী প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি চলছে। তবে দীর্ঘ ১৫ বছর দলীয়ভাবে নিয়োগ ও পদায়নের কারণে ব্যাপক যাচাই-বাছাইয়ের পরও নিরপেক্ষ পুলিশ কর্মকর্তা খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তালিকায় কিছু কর্মকর্তার নাম এখনো দেওয়া যায়নি। তাই আগের নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করলেও বাহিনীতে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ বলে পরিচিত কর্মকর্তার খোঁজ চলছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, গত তিনটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা পদস্থ কর্মকর্তাদের বাদ দিলে সেই অর্থে কর্মকর্তা পাওয়া কঠিন। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে বড় ধরনের রদবদল করাও জটিল প্রক্রিয়া। একদম ঊর্ধ্বতনদের বাদ দিয়ে নিম্নপদস্থদের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তুলনামূলক কম বিতর্কিত পুরোনো কর্মকর্তাদেরও দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। না হলে এতগুলো কেন্দ্রে পুলিশ মোতায়েন কঠিন হয়ে যাবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পুলিশ বাহিনীতে ১১৭ জন ডিআইজি, ৩৩৯ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, ৭৪৬ জন এসপি, ৯৪১ জন অতিরিক্ত এসপি, ৮৯৯ জন এএসপি ও ৪ হাজার ৯৮২ জন পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) কর্মরত রয়েছেন। নির্বাচনে মাঠপর্যায়ে এসব পদের কর্মকর্তারাই পুলিশ সদস্যদের নেতৃত্ব দেন।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে এসপি ও থানার ওসিদের লটারির মাধ্যমে পদায়ন করা হবে। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন চাইলে বদলি করতে পারবে।

পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, সেপ্টেম্বর থেকে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে নির্বাচনবিষয়ক বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ জন্য সদস্যদের তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে। প্রশিক্ষণ চলবে নভেম্বর পর্যন্ত। পুলিশ ও আনসার সদস্যদের পাশাপাশি এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ৮০ হাজারের বেশি সদস্য মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সব বাহিনী মিলে প্রায় আট লাখ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে ১ লাখ ৭৪ হাজার পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে ৮০ হাজার সদস্য নির্বাচনকালীন মাঠে ছিলেন এবং বাকি ৯৪ হাজার সদস্য ভোটের তিন দিন আগে মাঠে নেমেছিলেন। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনেও প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার পুলিশ সদস্য মাঠে ছিলেন। এই নির্বাচনে পুলিশ সদস্যদের সহযোগিতায় ভোটের আগের রাতেই ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ভরার অভিযোগ আছে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ৬ লাখ সদস্য নিয়োজিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ভোটের সময় সরাসরি দায়িত্বে ছিলেন প্রায় ৮৫ হাজার পুলিশ সদস্য।

আগের তিন নির্বাচনে বিতর্কিত ভূমিকা পালনকারী অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ৪০ কর্মকর্তার পুলিশ পদক বাতিল করা হয়েছে।

আইজিপি অবশ্য বলেছেন, ১৯৯১, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে পুলিশ নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করেছিল। এবারও সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হবে। আসন্ন নির্বাচনে পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না।

সার্বিক বিষয়ে অপরাধ নিয়ে কাজ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, এত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে নির্বাচনে অনভিজ্ঞদের দায়িত্ব দিলে কাজটা কিছু কঠিন হবে। তবে পুলিশের পেশাদারত্ব বজায় রাখতে পারলেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। এরপরও নতুনদের গোপনে পক্ষপাত এড়াতে নজরদারিতে রাখতে হবে।


ক্রাইম জোন ২৪

আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button