উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীরা চীনকেই কেন বেছে নেবে


চীনের সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন শাকিল আহমেদ। পড়াশোনার পাশাপাশি চীনে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সহায়কমূলক কনটেন্ট তৈরি করে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি। তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে চীনে উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শুনে লিখেছেন মোফাজ্জল হোসেন।
চীন একটা বহুল বৈচিত্র্যময় দেশ। এখানে আসার পর দেখেছি, স্থানীয়রা চীনের সংস্কৃতিগুলো খুব জোরালোভাবে প্রচার করে। চীন বৃহৎ দেশ হওয়ায় একেক প্রদেশে একেক ধরনের সংস্কৃতি দেখা যায়। নিরাপত্তার দিক দিয়েও চীন অন্যতম। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য চীনের নিরাপত্তা অত্যন্ত যত্নসহকারে রক্ষা করা হয়। এ ছাড়া অন্যান্য দেশ থেকে চীন ভিন্ন। যেমন অন্যান্য দেশে বর্ণবৈষম্য থাকলেও, এখানে তা পাবেন না। এখানকার মানুষ খুবই অতিথিপরায়ণ। চীনে পেমেন্ট ব্যবস্থা অত্যন্ত দক্ষভাবে ব্যবহৃত হয়, বয়স্ক মানুষ ছাড়া তেমন কেউ ক্যাশ ব্যবহার করেন না। আর ট্রান্সপোর্টেশন খুবই দ্রুত। মুহূর্তেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গন্তব্যে যাওয়া যায়। এসব করণে শুধু বাংলাদেশি নয়, বিশ্বের অনেক দেশের শিক্ষার্থীদের কাছেই চীন আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।
কেন চীনকেই বেছে নেবেন
যাঁরা ম্যানেজমেন্ট বা বিজনেস রিলেটেড বিষয়ে পড়াশোনা শেষে ব্যবসা অথবা পর্যটনশিল্পে ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাঁদের জন্য চীন অনন্য। তবে আমি বলব, পড়াশোনায় ইঞ্জিনিয়ারিং বা অন্যান্য ডিপার্টমেন্টকে বেছে না নিয়ে শুধু ম্যানেজমেন্ট বা বিজনেস সম্পর্কীয় বিষয় বেছে নিলে অবশ্যই সুবিধা পাবেন। তা ছাড়া যাঁদের ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে পড়ার আর্থিক অবস্থা নেই, তাঁরা স্বল্প খরচে চীনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। আর চীনের সরকার অনেক বেশি বৃত্তি দেয়। আপনি এখানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি করে সহজেই অন্য দেশে মুভ করতে পারবেন। কেননা বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষায় বিদেশে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আবার অ্যাম্বাসি ফেস করতেও ঝামেলা পোহাতে হয়, সে ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীরা চীনকে বেছে নিতে পারেন।
রয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা
চীনে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন অন্য দেশের তুলনায় চীনে বেশি বৃত্তি পাওয়া যায়। বিদেশে স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা পিএইচডির ক্ষেত্রে বৃত্তি পাওয়া অনেক কঠিন বা বেশি খরচে পড়তে হয়। সেখানে চীন সরকার বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের বৃত্তি দেয়। আবার বৃত্তি ছাড়াও কম খরচে উচ্চমানের শিক্ষার সুবিধা দিয়ে থাকে চীন।
লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকরির সুযোগ
চীনে পড়ালেখার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ রয়েছে, তবে খুব কম। সপ্তাহে ৮ ঘণ্টা এবং ভ্যাকেশন সময়ে প্রতি সপ্তাহে ১৬ ঘণ্টা কাজের সুযোগ আছে। আর এটা শুধু যাঁরা টপ র্যাঙ্কিং ইউনিভার্সিটিতে পড়েন, তাঁরাই এই সুযোগটা পান। বড় সিটিগুলো এই সুযোগ দিয়ে থাকে। আমি পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ পেয়েছি ইউনিভার্সিটি থেকে। অবশ্যই তাদের রুলস-রেগুলেশন মেনে কাজ করতে হয়েছে। খণ্ডকালীন কাজের অনেক কন্ডিশনের মধ্যে আপনার মেজর বা বিষয় সম্পর্কিত কাজ করতে হবে। এরপর কোম্পানি থেকে অফার লেটার এবং ভার্সিটি কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে কাজ করতে হবে। আর আপনি তৃতীয় সেমিস্টার থেকে সপ্তম সেমিস্টার অর্থাৎ ২য় বর্ষ থেকে শুরু করে ৪র্থ বর্ষের প্রথম সেমিস্টার পর্যন্ত কাজ করতে পারবেন।
চায়নিজ বনাম ইংলিশ মিডিয়াম প্রোগ্রামের পার্থক্য
আমি বলব, চায়নাতে পড়তে আগ্রহীরা অবশ্যই ইংলিশ মিডিয়ামে আসবেন। কেননা চায়নিজ ভাষায় যতই ফ্লুয়েন্সি হোন না কেন, যখন চায়নিজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পড়বেন, তখন অনেক জটিলতার সম্মুখীন হবেন, এটা তো আপনার মাতৃভাষা না। এ ছাড়া অনেক পার্থক্য ও সুবিধা-অসুবিধা দুটোয় আছে। চায়নিজ মাধ্যমে বেশি সুবিধা পাবেন, যা ইংলিশ মাধ্যমে নেই। অসুবিধা হলো, চায়নিজ মাধ্যমে পড়তে হলে আপনাকে চায়নিজ বাচ্চাদের সঙ্গে পড়তে হবে, অ্যাসাইনমেন্টগুলোও তাদের সঙ্গেই করতে হবে। তবে টপ র্যাঙ্কিং ভার্সিটিগুলোতে চায়নিজ মাধ্যমে থেকে ইংরেজি মাধ্যম ভালো, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য। তাই আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ইংরেজি মাধ্যমকে প্রিপার করব। কেননা আমার পরিচিত অনেকে চায়নিজ মাধ্যমে এসে ভুক্তভোগী হন, এমনকি অনেকের বৃত্তি বাদ হয়ে যায়। তারপর শিফট করে অন্য বিষয়ে নিজের টাকা দিয়ে পড়তে হয়।
ভর্তির আবেদনের জন্য যেসব ডকুমেন্ট লাগবে
চীনে আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টগুলো সাধারণত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় বা দেশের মতোই। আপনি যদি স্নাতকে ভর্তি হতে চান, সে ক্ষেত্রে এসএসসি ও এইচএসসির সার্টিফিকেট এবং মাস্টার্সের জন্য শুধু ব্যাচেলরের সার্টিফিকেট লাগবে। এ ছাড়া ট্রান্সক্রিপশন, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, পাসপোর্ট, নিজের ফরমাল ছবি, স্টেটমেন্ট অব পারপাস (এসওপি), ব্যাংক স্টেটমেন্ট, রিকমান্ডেশন লেটার–এগুলোই।
স্কলারশিপ ও আবেদনপ্রক্রিয়া
চীন বেশ কিছু স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। তার মধ্যে জনপ্রিয় স্কলারশিপ হলো China Scholarship Council (CSC), যা চায়নিজ গভর্নমেন্ট কর্তৃক দিয়ে থাকে। এ ছাড়া Provincial Government scholarship (PGS), University scholarship-সহ অনেক ধরনের স্কলারশিপের সুযোগ-সুবিধা চায়নাতে আছে। আবেদনপ্রক্রিয়া খুবই সহজ, CSC স্কলারশিপে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। আর PGS, University Scholarship বা অন্যান্য স্কলারশিপে তাদের ওয়েবসাইট থেকেই আবেদন করতে পারবেন।
আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য পরামর্শ
আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য আমার পরামর্শ হলো, চীনে আসার আগে অবশ্যই কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। সেটি হলো আপনি কোন বিষয়ে পড়তে আসছেন? চীনে এর ভ্যালু এবং ক্যারিয়ার কেমন? আরেকটা বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখবেন, ভাষাগত দিক। যদি চীনে পড়তে আসতে চান, তাহলে চীনা ভাষায় লেভেল ফোর, যেটাকে HSK score বলা হয়, এটাতে পাস করতেই হবে। অন্যথায় আপনার ইউনিভার্সিটি কখনোই সার্টিফিকেট দেবে না। তার মানে আপনাকে চীনা ভাষা শিখতেই হবে। আপনি যদি চীনা ভাষা শিখতে না চান, তাহলে এখানে এসে বিপদে পড়তে হবে। আর আপনি যদি এমন ধারণা রাখেন যে চীনে এসে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করে
নিজের খরচ নিজে চালাবেন বা বাড়িতে টাকা পাঠাবেন, এটা কিন্তু প্রথমাবস্থায় পারবেন না।